▆ কাদের উপর তাকলীদ বা মাযহাব ওয়াজিব আর কাদের উপর ওয়াজিব নয় ▆

তাকলীদের আভিধানিক অর্থ গলায় বেষ্টনী বা হার লাগানো।

শরীয়তের পরিভাষায় তাকলীদ হলো-কারো উক্তি বা কর্মকে নিজের জন্য শরীয়তের জরুরি বিধান হিসেবে গ্রহণ করা। কেননা তাঁর উক্তি বা কর্ম আমাদের জন্য দলীল রূপে পরিগণিত। কারণ, উহা শরীয়তে গবেষণা প্রসূত।

প্রসিদ্ধ নূরুল আনোয়ার গ্রন্থে বর্ণিত আছে-'হুসসামীর' টিকায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ অধ্যায়ের ৮৬ পৃষ্ঠায় 'শরহে মুখতাসারুল মানার' হতে উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ তাকলীদ হলো কোনো দলীল প্রমাণের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে কোনো গবেষকের উক্তি বা কৃতকর্ম শুনে তাঁর অনুসরণ করা।

ইমাম গাজ্জালী (রঃ) কিতাবুল মুস্তাফা এর ২য় খণ্ড ৩৮৭ পৃষ্ঠায় বলেছেনঃ
তাকলীদ হলো কারো উক্তিকে বিনা দলীলে গ্রহণ করা।

মুসাল্লামুস ছবুত গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
তাকলীদ হলো কোনো দলীল প্রমাণ ব্যতিরেকে অন্যের কথানুযায়ী আমল করা।
যেমন আমরা ইমাম আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহে আলাইহের ফিকহি উক্তি ও কর্মকে শরীয়তের মাসআলার দলীল রূপে গণ্য করি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরীয়তের দলীলাদি দেখার প্রয়োজন বোধ করি না।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) যদি কোরআন বা হাদীস বা উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত দেখে কোনো মাসআলা ব্যক্ত করেন তাও যেমনি গ্রহণযোগ্য, আবার নিজস্ব কিয়াস বা যুক্তি গ্রাহ্য কোনো মত প্রকাশ করেন তাও গ্রহণীয় হবে।
যে সব মাসায়েল কোরআন হাদীস বা ইজমায়ে উম্মত থেকে গবেষণা বা ইজতিহাদ প্রয়োগ করে বের করা হয়েছে, ঐ সমস্ত মাসায়েল মুজতাহিদ নন এমন লোকের জন্য তাকলীদ ওয়াজিব।
আর মুজতাহিদ হলেন এমন মুসলমান যিনি নিজ জ্ঞান ও যোগ্যতায় কোরআনি ইঙ্গিত ও রহস্যাবলী বুঝতে পারেন, কালামের উদ্দেশ্য অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখেন, গবেষণা করে মাসায়েল বের করতে পারেন, নাসিখ ও মানসুখ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন, ইলমে ছরফ, ইলমে নাহু, বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন, যাবতীয় আহকামের সাথে সম্পর্ক যুক্ত সমস্ত আয়াত ও হাদীস সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখেন।
সর্বোপরি যিনি মেধা, প্রজ্ঞা ও বোধশক্তির অধিকারী হন। আর সে ব্যক্তি ঐ স্তরে পৌঁছতে পারেনি যার মধ্যে উল্লেখিত যোগ্যতা নাই, সে হলো গায়রে মুজতাহিদ/মুকাল্লিদ (অনুসারী)। গায়রে মুজতাহিদের জন্য মুজতাহিদের তাকলীদ বা অনুসরণ করা একান্ত জরুরি।
[গ্রন্থ সূত্রঃ 'তাফসীরাতে আহমদীয়া' শেখ আহমদ মোল্লা জিউন (রঃ) কৃত: দ্র:।]

মুজতাহিদের ছয়টি শ্রেণী আছেঃ
১. শরীয়তের মুজতাহিদ ঐ সমস্ত জ্ঞানী-গুণীজন যাঁরা ইজতিহাদের নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন।
যেমন ধর্মীয় চার ইমাম হযরত আবু হানিফা (রঃ), হযরত শাফিঈ (রঃ), হযরত মালিক (রঃ) ও হযরত আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ)।

২. মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত মুজতাহিদগণ, তাঁরা হলেন ঐ সমস্ত ধর্মীয় ইমাম যাঁরা প্রথমোক্ত শ্রেণীর মুজতাহিদ কর্তৃক নীতিমালার অনুসরণ করেন এবং ঐ সমস্ত নীতিমালার অনুসরণ করে নিজেরাই শরীয়তের আনুষঙ্গিক মাসায়েল বের করতে পারেন।
যেমন : ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ), ইমাম মুহাম্মদ (রঃ), ইমাম ইবন মুবারক (রঃ), ইমাম যোফার (রঃ)।
তাঁরা সবাই ইজতিহাদের মৌলিক নীতিমালার ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর অনুসারী।
কিন্তু মাসায়েলে নিজেরাই মুজাতাহিদ।

৩. মাসআলা সমূহের মুজতাহিদ হলেন ঐ সকল ইমাম যাঁরা মৌলিক নীতিমালা ও আনুষঙ্গিক মাসায়েলের ক্ষেত্রে অন্যের অনুসারী কিন্তু তাঁরা যে সব মাসায়েলে ইমামগণের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না ওগুলোর সমাধান কোরআন হাদীস প্রভৃতি প্রামাণ্য দলিলাদি থেকে বের করতে পারেন।
যেমন : ইমাম তাহাবী (রঃ), কাযী খান (রঃ), সরখসী (রঃ) প্রমুখ।

৪. আসহাবে তাখরীজ হলেন ঐ সমস্ত মুজতাহিদ যাঁরা ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেন নি তবে ধর্মীয় ইমামগণের কারো অস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত উক্তির বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের যোগ্যতা রাখেন।
যেমন : ইমাম করখী (রঃ) প্রমুখ।

৫. আসহাবে তারজীহ হলেন ঐ সকল মুজতাহিদ যাঁরা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর একাধিক রেওয়ায়েত থেকে একটিকে প্রাধান্য দিতে পারে, যদি কোনো একটি মাসায়ালায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ) দু ধরনের রেওয়ায়েত থাকে তাঁরা কোনটাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে তা বলতে পারেন। অনুরূপ কোনো মাসআলায় ইমাম সাহেব (রঃ) ও সাহেবাঈনের [ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)] মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হলে তাঁরা যাচাই করে যে কোনো একজনের উক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে মন্তব্য করতে পারেন যে উক্তি সমূহের মধ্যে এ উক্তিটাই গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য আর অন্যটি অগ্রাহ্য।
যেমন : কুদুরী ও হেদায়া ইত্যাদি।

৬. আসহাবে তামীয হলেন ঐ সকল মুজতাহিদ যাঁরা জাহির মাযহাব ও কম গুরুত্বপূর্ণ রেওয়ায়েতের মধ্যে কিংবা দুর্বল জোরালো ও সর্বাধিক জোরালো উক্তি সমূহের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন। এ যোগ্যতার ভিত্তিতে অগ্রাহ্য উক্তি ও দুর্বল রেওয়ায়েত সমূহ বর্জন করে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উক্তি সমূহ গ্রহণ করেন।
যেমন : কাঞ্জুদ্দাকাইক ও দূররুল মুখতার ইত্যাদি গ্রন্থের প্রণেতা।
যাদের মধ্যে উল্লেখিত ছয়টি স্তরের কোনোটির যোগ্যতা নাই তারা নিছক অনুসারী বা মুকাল্লিদ হিসেবে পরিগণিত।
যেমন আমরা ও আমাদের যুগের সাধারণ আলেমগণ। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো কিতাব দেখে বা অধ্যয়ন করে জনগণকে মাসাইল শিক্ষা দেয়া।
[গ্রন্থ সূত্রঃ মুকাদ্দামায়ে শামী তাবাকাতে ফুকাহা এর বিবরণ দ্র:।]
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস হলো শরীয়তের মূলনীতি, যার মাধ্যমে শরীয়তের ইমামগণ যাবতীয় মাসায়েল বের করে মুতাআখখেরীন উম্মতের জন্য অর্থাৎ শেষ জামানা তথা বর্তমান সময়কার উম্মতের জন্য বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।
অথচ একদল মূর্খ নামধারী মুসলমান লা-মাযহাবী বা আহলে হাদীছ নামে উম্মতের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করতেছে মাজহাবের তথা শরীয়তের ইমামগণের বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে।
কোনো কোনো লা-মাযহাবী আলেম বলে থাকেন যেহেতু আমাদের ইজতিহাদ অর্থাৎ কোরআন হাদীস থেকে মাসায়েল বাহির করার ক্ষমতা আছে, সেহেতু আমরা কোনো মাযহাব বা ইমামের অনুসরণ করি না।
এ অবান্তর উক্তির জন্য দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই।

ইজতিহাদের জন্য কতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন আর তারা কতটুকু জ্ঞানের অধিকারী সে প্রসঙ্গে নিম্নে বর্ণিত হলোঃ
হযরত ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রঃ), ইমাম গাজ্জালী (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), হযরত ইমাম আবু দাউদ (রঃ), গাউছে পাক বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রঃ), হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ), হযরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দী (রঃ), হযরত খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ), হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রঃ) প্রমুখ ইসলামের এত উন্নত মর্যাদার অধিকারী ও মাশায়িখ ছিলেন যে, তাঁদের নিয়ে সারাবিশ্বের মুসলমানগণ যতই গর্ববোধ করুক না কেনো তা তাঁদের জ্ঞান গরিমা ও প্রজ্ঞার তুলনায় নেহায়েত কিঞ্চিতরূপে প্রতিভাত হবে।
অথচ উনাদের মধ্যে কেউ মুজতাহিদরূপে স্বীকৃত পাননি বরং তাঁরা ছিলেন মুকাল্লিদ বা অনুসারী।
কেউ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এঁর আর কেউ ইমাম শাফেঈ (রঃ) এঁর অনুসারী বা মুকাল্লিদ ছিলেন।
বর্তমান জামানায় উনাদের সমপরিমাণ মর্যাদা ও যোগ্যতার অধিকারী কেউ আছেন!
যখন উনাদের জ্ঞান মুজতাহিদ এর স্তরে উপণীত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তখন যারা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের নামগুলো ঠিকমতো বলতে পারে না তারা আবার নিজেদেরকে লা-মাযহাবী বা আহলে হাদীস বলে বেড়ায়, এ লজ্জা রাখার স্থান নাই। এরা হলো জামানার আবু জাহিল।
তাদের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে, এজন্য তারা সঠিকপথের সন্ধান লাভে বঞ্চিত।

তাকলীদ বা মাযহাব ওয়াজিব হওয়ার দলিলঃ
তাকলীদ বা যে কোন ইমামের মাযহাব মানা ওয়াজিব, এটা কোরআনের আয়াত, সহীহ হাদীস শরীফ, উম্মতের কর্মপন্থা ও তাফসীরকারকগণের উক্তিসমূহ দ্বারা প্রমাণিত।
১/ পবিত্র কোরআনের সূরায়ে ফাতেহায় বর্ণিত আছে 'ইহ্দিনাস সিরাত্বাল মুসতাকীম, সিরাত্বাল্লাযিনা আন্আমতা আলাইহিম' অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত করো। ওনাদের পথে যাঁদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ।
এখানে সোজা পথ বলতে ওই পথকে বোঝানো হয়েছে যে পথে আল্লাহর নেক বান্দাগণ চলেছেন। সমস্ত তাফসীরকারক, মুহাদ্দিছ, ফিক্হবিদ, ওলী আল্লাহ, গাউছ, কুতুব ও আবদাল হচ্ছেন আল্লাহর নেক বান্দা, আর তাঁরা সকলেই মুকাল্লিদ বা যে কোনো মাসহাবের অনুসারী ছিলেন।
সুতরাং তাকলীদই অর্থাৎ মাযহাবই হলো সোজা পথ।
কোনো মুহাদ্দিছ মুফাস্সির ও ওলী আল্লাহ লা-মাযহাবী ছিলেন না।
লা-মাযহাবী হলো ঐ ব্যক্তি যে মুজতাহিদ না হয়েও কারো অনুসারী নয়।

২/ ক্বুরআ'নুল কারিম এঁর আয়াত দেখুন,
আল্লাহ্ তায়ালা কারো উপর ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।
এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো আল্লাহতায়ালা কারো উপর সাধ্যাতীত কার্যভার চাপিয়ে দেন না।
সুতরাং যে ব্যক্তি ইজতিহাদ করতে পারে না, কোরআন থেকে মাসায়েল বের করতে পারে না তার দ্বারা তাকলীদ না করিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধান বের করানো তার উপর ক্ষমতা বহির্ভূত কার্যভার চাপানোর নামান্তর।

৩/ আরেকটি আয়াত দেখুন,
আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ প্রদানকারী রয়েছেন তাদেরও।
এ আয়াত শরীফে তিনটি সত্ত্বার আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(১) আল্লাহর কোরআনের আনুগত্য,
(২) রাসুলের হাদীসের আনুগত্য,
(৩) আদেশ দাতাগণের (ফিকহবিদ, মুজতাহিদ, আলিমগণ) আনুগত্য।
লক্ষ্যণীয় যে, উক্ত আয়াতে 'আতীউ' শব্দটি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে।
মহান আল্লাহর জন্য একবার এবং রাসুল সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম ও আদেশ প্রদানকারীদের জন্য একবার।
এর রহস্য হলো :
আল্লাহ যাহা হুকুম করবেন শুধু তাই পালন করা হবে, তাঁর কর্ম কিংবা নীরবতার ক্ষেত্রে আনুগত্য করা যাবে না।
তিনি কাফিরদেরকে আহার দেন, কখনো কখনো তাদেরকে বাহ্যিকভাবে যুদ্ধে মুসলমানদের উপর জয়ী করান। তারা কুফুরী করলেও সাথে সাথে শাস্তি দেন না।
এ সব ব্যাপারে আমরা আল্লাহকে অনুসরণ করতে পারি না। কেননা এতে কাফেরদের সাহায্য করা হয় যাহা নিষিদ্ধ।
কিন্তু নবী পাক সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম ও মুজতাহিদ ইমামের প্রত্যেকটি হুকুমে, প্রত্যেকটি কাজে এমনকি যে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁরা নীরবতা অবলম্বন করেন সে সমস্ত ক্ষেত্রেও আনুগত্য করা যায়।
এ পার্থক্যের জন্যই 'আতীউ' শব্দটা দুবার ব্যবহৃত হয়েছে।
যদি কেউ বলে 'উলীল আমর' দ্বারা ইসলামী শাসনকর্তাকে বোঝানো হয়েছে, এতে উপরোক্ত বক্তব্যে কোনোরূপ তারতম্য ঘটবে না।
কেননা শুধু শরীয়ত সম্মত নির্দেশাবলীতেই শাসনকর্তার আনুগত্য করা হবে। শরীয়ত বিরোধী নির্দেশাবলীর আনুগত্য করা হবে না।
ইসলামী শাসনকর্তা হচ্ছেন শুধু হুকুম প্রয়োগকারী। তাঁকে শরীয়তের যাবতীয় আহকাম মুজতাহিদ আলিমগণের নিকট থেকে জেনে নিতে হবে।
সমস্ত প্রজাদের হাকীম বাদশা হলেও বাদশাহর হাকীম হচ্ছেন মুজতাহিদ আলিম।
সুতরাং 'উলীল আমর' হলেন মুজতাহিদ আলিমগণই।
উলীল আমর বলতে যদি ইসলামী বাদশাকে ধরে নেয়া হয় তাতেও বাদশাহর তাকলীদই প্রমাণিত হয়।
কাজেই তাকলিদ (অনূসরন) অস্বিকারের সুযোগ নেই।
মনে রাখতে হবে,
এ আয়াতে আনুগত্য বলতে শরীয়তের আনুগত্যই বোঝানো হয়েছে।
যেমন :
*১-
"আতীউল্লাহ্ এঁর প্রমান দেখুন-
অন্তঃসত্ত্বা নয় এমন নারীর স্বামী মারা গেলে তাকে চার মাস দশদিন ইদ্দত পালন করা আল্লাহর নির্দেশ। আতীউল্লাহ থেকে এ অনুশাসন গৃহীত হয়েছে।
*২-
"আতীউর রসূলা" এঁর প্রমান দেখুন-
আর কতোগুলো অনুশাসন সরাসরি হাদীস শরীফ থেকে। যেমন সোনা রূপা নির্মিত অলংকার পুরুষের জন্য হারাম, এটা আতীউর রাসুল এর অন্তর্গত।
*৩-
"আতীউ উলীল আমরে মিনকুম" এর প্রমান দেখুন-
আর কতোগুলো মুজতাহিদগণের আদেশের আওতায় যাহা কোরআন হাদীসে নেই।
যেমন স্ত্রীর সাথে পায়ুকামে লিপ্ত হওয়া হারাম হওয়ার বিধান মুজতাহিদগণের দেয়া, যাহা 'উলীল আমরে মিনকুম' এর আওতায় বলা হয়েছে।

৪/ ক্বুরআ'নের আয়াত দেখুন-
যে দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের নিজ নিজ ইমাম সহকারে ডাকবো।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
অর্থ : ইমাম হচ্ছেন ধর্মীয় পথের দিশারী। তাই কিয়ামতের দিন লোকদিগকে হে হানাফী, হে শাফেঈ বলে আহ্বান করা হবে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ইমামের সাথে ডাকা হবে, হে হানাফী মতাবলম্বীগণ, হে মালেকী মাযহাবের অনুসারীগণ।
এখন প্রশ্ন হলো, যে দুনিয়াতে ইমাম বা মাযহাব মানেনি তাকে কার সাথে ডাকা হবে? এ সম্পর্কে সুফীয়ানেকেরাম বলেন, যার ইমাম নাই তার ইমাম হলো শয়তান।

তাফসীরকারক মুহাদ্দিছগণের অভিমতঃ
প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্থ দারমীর 'আল ইক্তিদাউ বিল উলামা' অধ্যায়ে আছে :
হযরত আতা থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুল সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম ও তোমাদের মধ্যে যারা আদেশদাতা আছেন তাদের আনুগত্য করো।
হযরত আতা বলেছেন, এখানে জ্ঞানী ও ফিক্হবিদগণকে আদেশ প্রদানের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

তাফসীরে খাযিনে :
অর্থাৎ যদি তোমরা না জানো জ্ঞানীদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করিও- আল কোরআন।
এ আয়াতটির ব্যাখ্যা লিখা হয়েছে,
তোমরা ঐ সকল মুমিনের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করো যারা কোরআনের জ্ঞানে পারদর্শী।

তাফসীরে দুররে মানসুরে:
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
ইবনে মারদাওয়াই হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস (রাঃ) বলেছেন, আমি হুজুর (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি যে কতেক লোক নামাজ পড়ে রোজা রাখে হজ্জ ও জিহাদ করে অথচ তারা মুনাফিকগণ্য হয়।
আরয করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কী কারণে তাদের মধ্যে নিফাক (মুনাফেকী) এসে গেলো?
প্রত্যুত্তরে নবী পাক (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ ফরমালেন নিজ ইমামের বিরূপ সমালোচনা করার কারণে।
ইমাম কে? একথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ বলেছেন- অর্থ : যদি তোমরা না জানো জ্ঞানীদের নিকট জিজ্ঞাসা করিও।
আয়াতে উল্লেখিত 'আহলে জিকরকে' ইমাম বলা হয়।
সংশ্লিষ্ট হাদীস শরীফ :
মুসলিম শরীফের ১ম খণ্ড ৫৪ পৃষ্ঠায় 'ইন্নাদ্দ্বীনা নাছিহাতুন' এর বর্ণনার অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, তামীমদারী থেকে বর্ণিত, হুজুর পাক (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ ফরমান 'ধর্ম হলো কল্যাণ কামনা'।
আমরা উপস্থিত সাহাবীগণ আরয করলাম, কার কল্যাণ কামনা?
তিনি ফরমালেন, আল্লাহর কিতাবের আর রাসুল (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) এর, মুসলমানদের মুজতাহিদ ইমামগণের এবং সাধারণ মুসলমানদের।
মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'নববীতে' এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
অর্থ : এ হাদীস উলামায়ে দ্বীনকেও ইমামদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উলামায়ে দ্বীন-এর কল্যাণ কামনার অর্থ হচ্ছে তাঁদের বর্ণিত হাদীসসমূহ গ্রহণ করা শরীয়ত বিধিতে অনুসরণ করা এবং তাঁদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করা।
মিশকাত শরীফে কিতাবুল ইমারাত এর ১ম পরিচ্ছেদে আছে,
অর্থ : যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ তাঁর গলে বায়আত বন্দন রইল না সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।
এখানে বায়আত বলতে তাকলীদ বা অনুসরণ এবং আওলিয়া কিরামের হাতে বায়াত গ্রহণ এ উভয় প্রকার বায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখন বলুন, লা-মাযহাবী আহলে হাদীস ওহাবীগণ কোন সুলতানের বায়াত গ্রহণ করেছেন?
তাকলীদের সমর্থনে যে কটি কোরআন শরীফের আয়াত ও হাদীস শরীফ বর্ণনা করা হলো এতদভিন্ন আরও অনেক আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা যেত।
কিন্তু সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এখানে ইতি টানা হল।
এখন উম্মতে মুহাম্মদীয়ার আমল পর্যালোচনা করে দেখা যায়,
তাবেয়ীন অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী (রঃ)-এর যুগ হতে আজ পর্যন্ত সমস্ত উম্মত তাকলীদের পথে অর্থাৎ মাযহাব মেনে আসছেন।
যিনি মুজতাহিদ নন তিনি অপর একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করেছেন।
উম্মতে ইজমার উপর আমল করার বিষয়টা কোরআন হাদীছ থেকে প্রমাণিত ও আবশ্যকীয়ও বটে।

আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন,
'সঠিক পথ প্রকাশিত হওয়ার পরেও যে ব্যক্তি রাসুল (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) এর বিরোধিতা করে, মুসলমান মোমেনদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চলে, তাকে আমি তার স্বীয় অবস্থায় ছেড়ে দিবো এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, এটা কতইনা নিকৃষ্ট স্থান।'
এ আয়াত থেকে বুঝা গেল সাধারণ মুসলমানদের জন্য মনোনীত যে পথ সে পথ অবলম্বন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।

তাকলীদের ব্যাপারে মুসলমানদের সার্বিক সম্মত বা ইজমা রয়েছে।
মিশকাত শরীফের 'আল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস্সুন্নাহ' অধ্যায়ে আছে,
সর্ববৃহৎ দলের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কেননা যে মুসলমানের দল থেকে পৃথক রয়েছে তাকে পৃথকভাবে জাহান্নামে পাঠানো হবে।
অন্য এক হাদীসে আরও বর্ণিত আছে,
যে পথ ও মতকে মুসলমানরা ভালো জানেন উহা আল্লাহর কাছেও ভালো ও পছন্দনীয় হিসেবে গণ্য।

এখন ভেবে দেখুন,
বর্তমানে এবং অতীতে সাধারণ মুসলমানগণ ব্যক্তি বিশেষে তাকলীদকে ভালো জেনে আসছেন অর্থাৎ মুকাল্লিদ বা যে কোনো মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
সুতরাং যে লা-মাযহাবী হলো সে ইজমায়ে উম্মতকে অস্বীকার করলো।
ইজমা বা সর্বসম্মত মতকে স্বীকার না করলে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকে কিরূপে প্রমাণ করবেন?
তাঁদের খিলাফত ইজমায়ে উম্মত থেকেই প্রমাণিত।
যে ব্যক্তি উনাদের একজনের খিলাফত অস্বীকার করে সে কাফির হিসেবে গণ্য।
[গ্রন্থ সূত্রঃ ফতওয়ায়ে শামী দ্র:।]

তাকলীদ সম্পর্কে আপত্তি ও এর জবাবঃ
সাহাবায়ে কেরাম কেন কারো তাকলীদ করেন নি?
উত্তরে বলতে হয়,
মিশকাত শরীফের ফাযাইলে সাহাবা অধ্যায়ে আছে,
'আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মতো, যে কারো অনুসরণ করো না কোনো সঠিক পথের সন্ধান পাবে।'
উল্লেখিত হাদীসে একই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, 'তোমরা আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অাঁকড়ে ধরো।'
সাহাবায়ে কেরাম রা. এর কারো তাকলীদ করার প্রয়োজন ছিল না।
কারণ, তাঁরা হুজুর পাক (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম)-এর সাহচর্য প্রাপ্ত হওয়ার পর মুসলমানদের নেতা বা ইমাম হিসেবে গণ্য।
তাই ইমাম আবু হানিফা (রাঃ), ইমাম শাফেই (রঃ) প্রমুখ ধর্মীয় ইমামগণ তাঁদেরই অনুসারী ছিলেন।
তাই সাহাবায়ে কেরাম রা. হলেন সবার ইমাম, তাঁদের ইমাম আবার কে হবেন!
সুতরাং আসুন, রাসুল (সল্লাল্লহু 'আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যৎ বাণী হিসেবে ৭৩ টি দলের মধ্যে ইসলামের সঠিক দল তথা জান্নাতী দল 'আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের' অনুসারী হয়ে বাকী ৭২টি জাহান্নামী দলকে পরিহার করি।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সিরাতুল মুসতাকীমে চলার তৌফিক দান করুন (আমীন)! বেহুরমাতি রাহমাতুল্লিল আলামীন।

মাজহাবঃ
▆ প্রসঙ্গ : মাযহাব না মানলে বুখারী, মুসলিম মানা যায় না।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1680169845631787

▆ মাযহাব মানলে মুশরিক হয় না; যাদের হাত ধরে ইসলাম তাঁরা সকলেই মাযহাবভূক্ত।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1666045127044259

▆ প্রসঙ্গ : সূন্নাহ্ মান্য; হাদিস নয়। সকল হাদিস, সূন্নাহ্ নয়।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1680658558916249

▆ প্রসঙ্গ : ফিত্না বা বিশৃঙখলায় আহালূস সূন্নাহ্ হওয়া বা সূন্নাহ্ আঁকড়ে ধরে থাকা।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1681169245531847

▆ মাযহাব এত কেন।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1743491289299642

▆ প্রসঙ্গ : দ্বীনের বুঝ (ফিক্বাহ্) অর্জনকারীদের অনূসরণ।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1681989658783139

▆ চার মাজহাবের কোন একটি কি একক ভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ? বিচার বিশ্লেষণ করে একেক মাসয়ালায় একেক মাজহাব মানা যাবে কি?
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813184972330273

▆ "সালাফী" দাবীটি ভূঁয়া (Bogus)।
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1686609804987791

▆ প্রসঙ্গঃ বিয়ে; লা মাযহাবী দৃষ্টিভঙ্গী।
ওহাবী লা-মাযহাবীদের কাছে প্রশ্ন- "মাযহাব/গবেষনা অস্বীকার করে নানী, দাদী ও নাতনীকে বিবাহ করবেন? নাকি মাযহাব/গবেষনা স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবেন?
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813357312313039

▆ লা-মাযহাবীদের অবস্থা।
https://m.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813387635643340

▆ সাহাবাযুগে তাকলিদ বা মাজহাব বা অনূসরণ ��
প্রশ্নঃ লা মাযহাবী শেখের মুরিদ / মুকাল্লিদেরা বলে থাকে, সাহাবা যুগে তাকলিদ ছিলনা। তাই আমরা ও কারো তাকলিদ করবোনা। মাজহাব মানব না। এটা কি ঠিক ?
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1813421288973308
________

 
Top