ইসলামে যয়ীফ হাদীসের গুরুত্বঃ ওয়াহাবীরা যয়ীফ হাদীসকে বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং একে জাল হাদীসের স্তরে নামিয়েছে। এবং উভয়কে একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
যয়ীফ হাদীস ফাযায়েল এবং মুস্তাহাব বিষয়ের ক্ষেত্রে আমলযোগ্য। এটিই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অভিমত।
ফুকাহাদের অধিকাংশ যয়ীফ হাদীসকে শরয়ী আহকাম তথা হালাল-হারাম ইত্যাদির জন্য প্রমাণ হিসেবে পেশ করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এবং তারা যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের তুলনায় শক্তিশালী মনে করেন। আর কিয়াস হল, শরীয়তের দলিল চতুষ্টয়ের একটি যাতে কোন সন্দেহ নেই।
যয়ীফ হাদীসের উপর আমলের ব্যাপারে রায় দিয়েছেন, তিন ইমাম, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) মুহাদ্দিসীনদের কেউ কেউ এ রায় গ্রহণ করেছেন। যেমন, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে আবী হাতেম। তবে এক্ষেত্রে দু’টি শর্ত রয়েছে,
শর্ত- ০১. মারাত্মক পর্যায়ের যয়ীফ না হওয়া।
শর্ত- ০২. সংশ্লিষ্ট মাসআলায় এ হাদীস ব্যতীত অন্য কোন হাদীস না থাকা।
আল্লামা ইবনে হাযাম এ মত গ্রহণ করেছেন। আল্লামা ইবনে হাযাম তাঁর বিখ্যাত কিতাব “আল-মুহাল্লা” তে লিখেছেন,
و هذا الأثر في دعاء القنوت –وإن لم يكن مما يحتج بمثله، فلم نجد فيه عن رسول الله صلي الله عليه و سلم غيره. و قد قال أحمد ابن حنبل رحمه الله :ضعيف الحديث أحب إلينا من الرأي. قال علي –و هو إبن حزم -: وبهذا نقول
“এটি দু‘য়ায় কুনুতের ব্যাপারে প্রমাণ স্বরূপ, যদিও এ ধরনের হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করা ঠিক নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেক অন্য কোন হাদীস আমাদের নিকট পেীঁছেনি, এজন্য আমরা এর মাধ্যমে দলিল প্রদান করে থাকি। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট কিয়াসের তুলনায় যয়ীফ হাদীস অধিক প্রিয়। আল্লামা ইবে হাযাম বলেন, “এটি আমাদেরও মত”
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এর ছেলে, আব্দল্লা (রহঃ) বলেছেন, আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন শহরে যদি কেউ কোন একটা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং সেখানে এমন একজন মুহাদ্দিস রয়েছে, যে সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের মধ্যে তারতম্য করতে পারে না, এবং আরেকজন আহলে রায়, (যে আলেম শুধু কিয়াস নির্ভর) রয়েছেন, তবে ঐ ব্যক্তি কার স্মরণাপন্ন হবে? আমার পিতা উত্তর দিলেন,
يسأل صاحب الحديث و لا يسأل صاحب الرأي. ضعيف الحديث أقوي من الرأي
তিনি উত্তর দিলেন, সে মুহাদ্দিসের কাছে জিজ্ঞেস করবে। এবং যে কিয়াস করে মাসআলা দিবে তার নিকট জিজ্ঞেস করবে না। কিয়াসের তুলনায় যয়ীফ হাদীস অধিক শক্তিশালী। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) কোন মাসআলার ক্ষেত্রে যখন কোন সহীহ হাদীস পেতেন না, তখন তিনি মুরসাল হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করতেন। অথচ ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর নিকট মুরসাল হাদীস যয়ীফ হাদীসের অন্তর্ভূক্ত। আল্লামা মাওয়ারদি (রহঃ) এর বরাত দিয়ে আল্লামা সাখাবী (রহঃ) বিষয়টি ফাতহুল মুগীছে উল্লেখ করেছেন।
শায়খ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক আল-গুমারী (রহঃ) “র্আ-রাদ্দুল মুহ্কামুল মাতিন, আলা কিতাবিল কাওলিল মুবিন লিমুহাম্মাদ আল-মুখাইমির” তে লিখেছেন,
و قولهم: الحديث الضعيف لا يعمل به في الأحكام: ليس علي إطلاقه كما يفهمه غالب الناس أو كلهم...
“মুহাদ্দিসগণ যে বলেছেন যয়ীফ হাদীস আমল যোগ্য নয়, এটিকে তাদের বক্তেব্যের বাহ্যিক অর্থে প্রয়োগ করা বিশুদ্ধ নয়, যেমনটি সাধারণ অনেক মানুষ কিংবা অধিকাংশ মানুষ বুঝে থাকে।
আল-মিয়ার নামক কিতাবের হস্তলিপি এর সংকলক তিনি অষ্টম শতাব্দীর হাফেযে হাদীস। তিনি কিতাবটিকে ফিকহী অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। এবং প্রত্যেক পরিচ্ছেদে ঐ সমস্ত যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেছেন যেগুলোর দ্বারা চার ইমাম সমষ্টিগতভাবে অথবা এককভাবে দলীল পেশ করেছেন। সাথে সাথে তিনি হাদীস যয়ীফ হওয়ার কারণ ও ত্রুটিসমূহ উল্লেখ করেছেন। এটি একটি মূল্যবান কিতাব, যা সংকলকের প্রচুর হিফয, হাদীস, ফিকহ ও মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের প্রমাণ বহন করে। এর সংকলক আল্লামা ইবনুল মুলাক্কিন।
যয়ীফ হাদীসের উপর আমলের কিছু ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন, দু’টি সহীহ হাদীস এর শব্দগুলো পরস্পর বিরোধী অর্থ প্রকাশ করে এবং উভয়ের মধ্যে কোন একটিকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য যদি শুধু যয়ীফ হাদীস পাওয়া যায় তাহলে উক্ত যয়ীফ হাদীসকে গ্রহণ করে একটা হাদীসকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এটি পূর্ববর্তী এবং পরর্বতী অধিকাংশ আলেমের অভিমত।
ইমাম বাইহাকী র. তার ‘আল-মাদখাল ইলা দালাইলিন নুবুুওয়্যাহ’ এর পরিশিষ্টে উল্লেখ করেছেন, [এটি আদ-দালাইল গ্রন্থের শুরুতে মুদ্রিত হয়েছে]
أَرَدْتُ وَ المَشِيْئةُ لِلَّهِ تَعَاليَ أنْ أجْمَعَ بَعْضَ مَا بَلَغَناَ مِنْ مُعْجِزَاتِ نَبِيِّنا مُحَمَّدٍ صلي الله عليه و سلم وَ دَلَائِلِ نُبُوَّتِهِ ...عَلَي نَحْوِ مَا شَرَطْتُ في مُصَنَّفَاتِي مِنَ الإكتِفَاءِ بِا لصَّحِيحِ مِنَ السَّقِيمِ وَ الإِجْتِزَاءُ بِا لمَعْرُوْفِ مِنَ الغَريْبِ، إلاَّ فِيما لاَ يَتَّضِحُ المُرادُ من الصَّحِيح أوِ المَعْرُوْفِ دُوْنه، فَأُوْرِدُه ، وَالإعْتِمَادُ علي جُمْلَةِ مَا تَقَدَّمَ من الصَّحِيْح أَوِ المَعْروْف عِنْدَ أهْلِ المَغَازِي وَ التَّوَاريِخِ
আমি ইচ্ছা করেছি, প্রকৃত ইচ্ছার মালিক আল্লাহ তায়ালা, নবীজী রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর যে সমস্ত মু’জেযা এবং নবুওয়াতের প্রমাণাদি আমাদের নিকট পৌঁছেছে, সেগুলো একত্র করবো, সেই শর্তের আলোকে যেগুলো আমি আমার রচনার জন্য নির্ধারণ করেছি অর্থাৎ শুধু সহীহ ও মা’রুফ হাদীস উল্লেখ যথেষ্ট মনে করবো। তবে কোন ক্ষেত্রে যদি শুধু সহীহ ও মা’রুফ হাদীস দ্বারা উদ্দিষ্ট অর্থ স্পষ্ট না হয়, সে ক্ষেত্রে তার নিম্নের স্তরের ঐ সমস্ত হাদীস উল্লেখ করবো যেগুলো ঐতিহাসিক ও যুদ্ধবেত্তাগণের নিকট সহীহ অথবা মা’রুফ।
ইমাম বাইহাকী র. সুনানে কুবরা-এ নামাযী ব্যক্তির সামনে সুতরা এর পরিবর্তে দাগ টেনে দেয়ার অধ্যায়ে এক রাবীর নামের বিষয়ে মতানৈক্য উল্লেখ করার পর লিখেছেন, ‘ইমাম শাফেয়ী র. তাঁর পূর্বের বক্তব্যে এ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন এবং নতুন মাযহাবের ক্ষেত্রে তিনি তাওয়াক্কুফ করেছেন অর্থাৎ মতামত পেশ করা থেকে বিরত থেকেছেন। বুওয়াইতীর কিতাবে তিনি লিখেছেন, নামাযী ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের সামনে রেখা অঙ্কন করবে না, যতক্ষন না তার নিকট হাদীসটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হবে। যদি হাদীসটি প্রমাণিত হয়, তবে তার অনুসরণ করবে। সম্ভবত তিনি রাবীর নামের ব্যাপারে যে মতানৈক্য রয়েছে, সে বিষয়ে অবগত হয়েছেন, সুতরাং এ ধরণের ফয়সালা দেয়াতে কোন অসুবিধা নেই।
মুকাদ্দামায়ে ইবনে সালাহ-এ ইমাম ইবনে সালাহ ইমাম বাইহাকীর উক্ত বক্তব্যের উপর নির্ভর করে উক্ত হাদীসকে মুজতারাব হাদীসের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। [উলুমুল হাদীস, ১৯তম প্রকার]।
ইমাম নববী র. মাজমু নামক কিতাবে লিখেছেন-
وَالتَّرْجِيحُ بِالمُرسَلِ جَائز
মুরসাল হাদীসের দ্বারা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া বৈধ।
অথচ সর্বজনবিদিত বিষয় হল, ইমাম নববী র. মুরসাল হাদীসকে যয়ীফ মনে করেন।
মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম ইবনু জুযাই আল-কালবী র. তাঁর তাফসীরগ্রন্থ আত-তাসহীল এর ভূমিকায় মুফাসসিরগণের বিরোধপূর্ণ বক্তব্যের কোন একটিকে প্রাধান্য দেয়ার বারটি পদ্ধতি আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন-
فَإذَا وَرَدَ عَنهُ عَلَيْه السلام تَفْسِيْرُ شَيْء مِنَ القُرْآن عَوَّلْنَا علَيْه وَ لَا سِيَّمَا إِنْ وَرَدَ فيْ الحَدِيْثِ الصَّحِيحِ
অর্থাৎ যখন রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে কুরআনের কোন তাফসীর বর্ণিত হয় তখন সেটা আমরা গ্রহণ করে থাকি, বিশেষভাবে যখন তা সহীহ হাদীসের মাধ্যমে বর্ণিত হয়।
এখানে বিশেষভাবে সহীহ হাদীসের... একথা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যয়ীফ হাদীসের দ্বারা বিরোধপূর্ণ বক্তব্যকে একটির উপর অপরটিকে প্রাধান্য দেয়া বৈধ।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম র. তাঁর তুহফাতুল মাউদুদ পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ذَلِكَ أَدْنَي أَنْ لاَ تَعُوْلُوْأ আয়াতে আউল শব্দের অর্থের ভিন্নতা উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া, যেমনটি বলেছেন ইমাম শাফেয়ী রা. না কি আউল অর্থ হল, জুলুম-অত্যাচার করা, যা অধিকাংশ মুফাসসিরের অভিমত।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম র. অধিকাংশ মুফাসসিরের বক্তব্যকে কয়েক কারণে প্রাধান্য দিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি কারণ হল, এ অর্থটি রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর একটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যদিও হাদীসটি গারীব, তবে তা প্রাধান্য দেয়ার যোগ্য। হাদীসটি হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) বলেছেন, أَنْ لاَ تَجُوْرُوا ইবনে হিব্বান র. হাদীসটি মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। অথচ আবু হাতেম রাযী র. হাদীসটি মারফু বলাকে ভুল সাব্যস্ত করেছেন, এবং তিনি হাদীসটিকে হযরত আয়েশার উপর মাউকুফ বলে উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী অধিকাংশ মুহাদ্দিস থেকে মতটি বর্ণিত হয়েছে। অথচ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম র. বলেছেন, হাদীসটি প্রাধান্য দেয়ার যোগ্য।
হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম, গবেষক আল্লামা ইউসুফ বাননূরী র. তাঁর অসাধারণ গ্রন্থ মা’আরিফুস সুনান -এ রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) যে দাঁড়িয়ে পেশাব করেছেন, তার কারণসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, لِعِلَّةٍ كَانَتْ بِبَاطِنِ رُكْبَتِه অর্থাৎ রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর হাঁটুর অভ্যন্তরে ব্যথা ছিল, এজন্য তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব করেছিলেন। যেমনটি ইমাম বাইহাকী র. তার সুনানে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি যদিও যয়ীফ, তবে তা কারণ বর্ণনার জন্য যথেষ্ট।
উপযুক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, পূর্ববর্তী ইমামগণের নিকটে যয়ীফ হাদীসেরও বিশেষ গুরুত্ব ও মূল্য রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছু লোক ঠিক এর উল্টো প্রচারণা চালিয়ে থাকে। তারা সাধারণভাবে যয়ীফ হাদীসকে বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং একে জাল হাদীসের স্তরে নামিয়েছে। এবং উভয়কে একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে।