��প্রসঙ্গ : সহীহ্-যয়ীফের বেড়াজালে মুসলিম উম্মাহ্ / সহীহ্-যয়ীফ নির্ধারনে অশুভ চাঁটনির খেল��

সাবধান! ভয়ঙ্কর ফিত্না! সম্পূর্ণ পড়ুন।

বর্তমান ওহাবী নামধারী আহলে হাদীসদেরকে আহলে হাদীস না বলে মুনকিরে হাদীস বা হাদীস অস্বীকারকারী বললে খারাপ হবে না।

অধিকাংশ মাসআলায় তাদের চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে, তারা রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله وسلم) এর হাদীস নিয়ে কী পরিমাণ তামাশা করে।
নিজের মতের বিরোধী হলে, একটা সহীহ হাদীসকেও অবলীলায় যয়ীফ বলে বসে।
নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য যয়ীফ কে সহীহ্ বলে মিথ্যা প্রচার করে।

হাদীসের সহীহ-জয়ীফ নির্ধারণ করা একটি শাস্ত্রীয় (একাডেমিক বা উস্তাদের সান্নিধ্যে পড়াশুনা সম্পর্কিত) বিষয়।
এই বিষয়ে পূর্ণযোগ্যতা ও বুৎপত্তি অর্জন শুধু কঠিনই নয়, সময় সাধ্যও। যোগ্য উস্তাদের সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় উসুলে হাদীসের বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন জরুরি।
এছাড়া আসমাউর রিজাল (রাবীদের নাম ও জীবনী) এর বিষয়টি তো একটি সাগরের মতো। এইসব বিষয়ে যোগ্য মুহাদ্দিস ও আলেমগণ গবেষণা করে থাকেন।

বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ হাদীসের ক্ষেত্রেই সহীহ-জয়ীফ নির্ধারণে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এমনকি বোখারী-মুসলিমের হাদীস নিয়েও গবেষণা ও অভিযোগ করার সুযোগ আছ।

সবাই একটা হাদীস সহীহ হওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে, এই ধরনের হাদীসের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
বরং সহীহ-জয়ীফ নিয়ে বিতর্কিত হাদীসের সংখ্যা বেশি। একজন মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন, অন্য একজন সেটাকে দুবর্ল বলে দিয়েছেন।

মূল বিষয় হলো, হাদীসের সহীহ-জয়ীফ নির্ধারণ যেহেতু একটি গবেষণার বিষয়, এইক্ষেত্রে আমরা আদৌ লাগামহীন গবেষণাকে সমর্থন করবো কি না?

আপনার কাছে একটা হাদীস সহীহ, আরেকজন সেটার উপর অভিযোগ করে জয়ীফ বলে দিলো, এইক্ষেত্রে করণীয় কী?
আপনি কি অপরজনের গবেষণা মানতে বাধ্য না কি অপরজন আপনার গবেষণা মানতে বাধ্য?
আপনি যখন একটা হাদীসকে সহীহ বললেন, এর অর্থ হলো আপনি হাদীসটি রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله وسلم) থেকে প্রমাণিত এই দাবী করছেন।
আর অপরজন যখন জয়ীফ বা দুবর্ল বলছে, তখন সেই দাবীর মাঝে কিছুটা সন্দেহ ঢুকে পড়ছে।
এইক্ষেত্রে আপনি সহীহ সাব্যস্থ করে হাদীসের বক্তব্যের উপর আমল করছেন, আর এখন অপরজন জয়ীফ সাব্যস্থ করলে আপনার জন্য করণীয় কী?
আপনি কি আপনার গবেষণা অনুযায়ী সহীহ এর উপর আমল করবেন না কি অপরজনের জয়ীফ বলায় সেটা ছেড়ে দিবেন?

যারা সাধারণ ছাত্র, তারাও জানে, ইমাম বুখারী রহ. ও ইমাম মুসলিম রহ. এর মাঝে হাদীসের সহীহ-জয়ীফের মূলনীতিগত একটি পার্থক্য আছে। বিষয়টি মাসআলাতুল লিকা (উস্তাদ-ছাত্রের সাক্ষাৎ প্রমাণিত হওয়া) নামে পরিচিত।
অনেক হাদীস ইমাম মুসলিম রহ.-র কাছে সহীহ হলেও ইমাম বুখারী রহ.-র কাছে সেটা সহীহ নয়।

বিষয়টির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করুন।

ইহা চাঁটনির খেল নয়; কোন খেল তামাশার বিষয়ও নয়, অথচ নামধারী আহলে হাদিসরা সাধারণ মানুষকে সেরুপই বুঝানোর মহড়া দিয়ে যাচ্ছে।
বলছে, কারো অনূসরণ করা যাবে না।
কারো অনূসরণ না করার ফল হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক, ঘড়ি মিস্ত্রী, কাঠ মিস্ত্রী, দিনমজুর সকলেই নিজ ইচ্ছামতো হাদিস সহীহ্-যয়ীফ নির্ধারনে ব্যস্ত হওয়া।

দেখুন,
আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধ খেলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার মান অর্জনের জন্য যেখানে আন্তর্জাতিক Coacher বা প্রশিক্ষকের দরকার হয় সেখানে আক্বিদা-ঈমান ও 'আমলের সাথে সম্পর্কিত ``হাদিস সহীহ্ ও যয়ীফ নির্ধারণ`` এর মতো বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে মা'মূলী হিসেবে তুলে ধরার সর্বব্যাপী কসরত করছে নামধারী আহলে হাদিসেরা।

ইমাম মুসলিম রহ.-র মতো এতো বড় ইমামের কাছে একটা হাদীস সহীহ অথচ সেটি ইমাম বুখারী রহ.-র কাছে সহীহ নয়।
এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি সাধারন মানুষের হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাড়াবে?

আপনি রাবীদের জীবনীর উপর একটি বই নিয়ে বসে গেলেন। বুখারী শরীফের রাবীদের জীবনী বের করা শুরু করলেন।
দেখলেন, বুখারী শরীফের অনেক রাবীর উপর বিভিন্ন ইমাম অভিযোগ করেছেন। এমনকি ইমাম বুখারী রহ. নিজেও বুখারী শরীফের অনেক রাবীর ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন।
ইমাম বুখারী রহ. রচিত আত-তারীখুল কাবীর ও আত-তারীখুস সগীরসহ অন্যান্য কিতাবে অনেক রাবীর নাম পাওয়া যাবে।
শরীযতের এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনি কেন গবেষকের আসনে বসতে আগ্রহী?
কেন কথায় কথায় সহীহ-জয়ীফ করতে থাকেন?
আপনি যখন দাবী করেন :
``এই বিষয়ে সহীহ হাদীস দেখান, তাহলে মানবো?
বা সবার ঐক্যমতে‍ যে হাদীস সহীহ সেটা দেখাতে হবে``
তখন এইরুপ দাবিকারীকে বলতে হয়, সমস্ত ইমাম একমত হয়েছেন এই ধরণের হাদীস কয়টা আছে?
যখন সহীহ হাদীসের কথা বলেন, তখন কার কাছে সহীহ সেটাও আপনার বলে দেয়া উচিৎ।
নতুবা এ বিষয়ে যেহেতু গবেষণার সুযোগ আছে, সেহেতু কেউ যদি অমুহাদ্দিস আলবানীর Reference এ একটা হাদীসকে সহীহ বলে, আপনি তো ইবনে উসাইমিনের রেফারেন্স নিয়ে আসবেন।
বলবেন, ইবনে উসাইমিন এটাকে জয়ীফ বলেছেন।
কেউ যদি ইবনে হাজার আসকালানী রহ. এর Reference এর হাদীসকে সহীহ বলে, আপনি তখন আলবানীর গবেষণা উল্লেখ করবেন।
আর এইভাবে ছোটাছুটি করতে থাকবেন। নিজেও দিশেহারা হবেন, অপরকেও দিশোহারা বানাবেন।

প্রকৃতপক্ষে হাদিস যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি প্রকৃত যোগ্য মুহাদ্দিসদের দায়িত্ব।
সনদের দিক থেকে হাদীস সহীহ হলেও সেটি দলিল হবে কি না, সে বিষয়েও মতবিরোধ আছে। অনেক ফকীহের নিকট মুরসাল হাদীস দলিলযোগ্য, আবার অনেকের নিকট দলিলযোগ্য নয়।
কোন একটি হাদীস সহীহ হওয়ার পরেও এর উপর আমল হবে কি না, সে বিষয়েও অনেক বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। হাদীসটি রহিতও হতে পারে। অথচ হাদিসটি সহীহ্। তাছাড়া উক্ত হাদীসের বিপরীত হাদীস থাকতে পারে। ফলে উভয়ের মাঝে সমন্বয় বা যে কোন একটাকে প্রাধান্য দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
এই সকল বিষয়ের সমাধান করার পর হাদীসের মর্ম উদ্ধার নিয়ে সহীহ্ ও যয়ীফ নির্ধারনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে হাদিস যাচাই বাছাইয়ের প্রাজ্ঞজনদের মাঝে বিতর্ক (Debate) শুরু হয়।
কোন প্রেক্ষাপটে, কী উদ্দেশ্যে রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله وسلم) কথাটি বলেছেন। কথাটি কি তিনি ব্যাপকভাবে সবার উদ্দেশ্যে বলেছেন, না কি কোন একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে বলেছেন। হাদীসের শব্দটি কি শুধু একটি অর্থেরই সম্ভাবনা রাখে, নাকি অন্য কোন অর্থ আছে। আরবী ভাষার যের-যবরের পরিবর্তনের কারণেও অর্থের পরিবর্তন হয়। দেখতে হয়, এই হাদীসেরও এই ধরণের কোন বিষয় ঘটেছে কি না।
হাদীস নিয়ে কী পরিমাণ মতবিরোধ হতে পারে একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে।

সাধারন ব্যক্তি নাসীরুদ্দীন আলবানীর তারাজুয়াত বা পূর্বের মতামত থেকে ফিরে আসার উপর উদা ইবনু হাসান উদা ৫০০ হাদীস সংকলন করেছে।

এই আলবানী এক সময় একটাকে সহীহ বললেও পরে সেটিকে জয়ীফ বলেছে।
আবার প্রথমে জয়ীফ বলে পরবর্তীতে আবার সেটিকে সহীহ বলেছেন। এই ধরণের পাঁচশ হাদীসের সংকলন এটি। শুধু পাঁচশ হাদীসেই এটি সীমাবদ্ধ নয়।
বরং আরও অসংখ্য হাদীসের ক্ষেত্রে এইরুপ ঘটেছে।
এই ধরণের অারও অনেক বিষয় রয়েছে।
এই সব কারণেই মূলত: ইমামদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ তার বিখ্যাত কিতাব আসারুল হাদীসে।

আমরা পূর্বেই বলেছি, বিষয়টি আল্লাহর ইবাদাতের জন্যই সৃষ্ট মানুষের আক্বিদা-ঈমান ও 'আমলের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। ইহাতে আক্বিদাগত যেকোন প্রকারের ভূল জীবনের সকল ইবাদাতকে বরবাদ করে দেয়।

প্রিয় পাঠক!
সাধারণ মুসলমানকে হাদীসের সহীহ-নির্ধারণের মতো শাস্ত্রীয় বিষয়ে টেনে এনে নামধারী সালাফী ও স্ব-ঘোষিত আহলে হাদীস খেলফী (বিরুদ্ধাচরনকারী)-রা অনেক বড় ভুল করে চলেছে।

কোন উস্তাদ বা একাডেমিক দারস বা পড়াশুনা ব্যাতীত শ্রেফ আরবী ভাষাভাষী হওয়ার কারনে সাধারন মানুষ (ঘড়ি মিস্ত্রীর পাশাপাশি নিজে নিজে পুস্তক অধ্যয়ন করে গবেষনাকারী) আলবানী জীবনের শেষের দিকে এসে এই বিষয়ে যে বেশ বড় ভুল হয়েছে তা অনুধাবন করেছিলো।
অথচ ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ রেজিস্ট্রিকৃত নামধারী আহলে হাদিস সম্প্রদায় সেই আলবানীকে পূঁজি করে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, জয়ীফ মানেই পরিত্যাক্ত। জয়ীফের উপর আমল হতেই পারে না।

এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, কার কাছে জয়ীফ?
সাধারন মানুষ আলবানীর কাছে জয়ীফ না কি ইবনে বাজের কাছে জয়ীফ?
এই ধরণের বহু উদাহরণ দেয়া যাবে একজন সহীহ বলে সেটার উপর আমলের ফতোয়া দিচ্ছেন, আরেকজন সেটাকে দুর্বল বলে আমল পরিত্যাগের দাওয়াত দিচ্ছে।
আমাদের বাংলাদেশে থাকা হাতে গোনা আহলে হাদীস নামধারী আলেমদের মধ্যেই এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
তাদের শায়খ আবু হাসসান রাইয়্যানের ``আহলে হাদীস আলেমদের ইখতিলাফ`` বইটি দেখা যেতে পারে।

মূল কথা হলো, শাস্ত্রীয় বিষয়ে সাধারণ মানুষকে টেনে এনে ইসলামের ক্ষতি করার কী প্রয়োজন?
যাদের কাছে সহীহ-জয়ীফের মূলনীতি আলোচনা করা হচ্ছে, তাদের কয়জন বিষয়টা বোঝার যোগ্যতা রাখে?
অনভিজ্ঞ লোককে যখন এ ময়দানে আনতে থাকবেন, এক সময় পুরো ইসলামের বিষয়ে সে আস্থাহীন হয়ে পড়বে।
যে বিষয়গুলো গবেষণার দাবী রাখে, সেগুলো গবেষকদের হাতেই থাকা নিরাপধ।
উম্মতের আক্বিদা-ঈমান-'আমাল-আখিরাত নিরাপদ থাকবে।
সবাই গবেষক হলে তাঁতি নষ্ট হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ দেখি না।

যারা এই দেশের যোগ্য আলেমদের প্রতি আস্থা রাখেন, তারা তাদের পথ ধরে সূন্নাহর অনুকূলে সিরত্বল মুস্তাকিমে আঁকড়ে থাকাই হবে নিরাপধ পথচলা।

 
Top