ইখতিলাফের প্রধান কারণ হাদীস না জানা বা না মানা কিনা তার আলোচনা।
অনেকে মনে করেন, মতভিন্নতার মৌলিক কারণ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্যদিকের হাদীস সম্পর্কে অবহিত না থাকা বা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে যুক্তি বা কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করা। অথচ আইম্মায়ে দ্বীন ও উলামায়ে হকের মধ্যে যে মতভিন্নতা হয়ে থাকে সে সম্পর্কে এ ধারণা করা মোটেও সঠিক নয়।
কেননা তাদের কেউ কিয়াস বা যুক্তিকে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেন না। তাদের কোনো কোনো ফতওয়া যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসের ব্যাপারে অবগতি না থাকার কারণে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এর সংখ্যা নিতান্তই কম।
আহলে হক উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিদ্যমান মতভিন্নতার অধিকাংশের মূলেই ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ-এর শরীয়ত স্বীকৃত বাস্তবিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য হাদীসের ইমামগণের মধ্যেও বহু বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে।
ইমাম আহমদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিব্বান, দাউদ জাহেরী, ইবনে হাযম জাহেরী তাদের ব্যাপারে হাদীসের বিরোধিতা বা হাদীসের ব্যাপারে অনবগতির অভিযোগ কি কেউ করতে পারে?
শুধু তাই নয়, পরবর্তী যুগের এবং বর্তমানের ঐসব আলেমের মধ্যেও ইখতিলাফ হয়েছে, যারা আহলে হাদীস বা সালাফী নামে পরিচিত।
এদের ব্যাপারে তথাকথিত সকল আহলে হাদীস বা সালাফী নামধারীরা একমত যে, এরা সবাই হাদীস বিশারদ এবং হাদীসের অনুসারী ছিলেন।
প্রথম উদাহরণ
______________
মিসরের প্রসিদ্ধ আলিম শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. (১৩৩৩-১৪২৫ হি.) ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ নামে একটি বেশ বড়, সহজ ও ভালো কিতাব রচনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, যা মাশাআল্লাহ নতুন প্রজন্মের মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত। অনেক তরুণ-যুবক এটিকে মুতাওয়ারাছ ফিকহী কিতাবের উত্তম বিকল্প মনে করে বরণ করে নিয়েছে।
তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীনের স্বল্পতার কারণে অনেকে এমনও মনে করে যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে আছে ইমামদের ফিকহ আর এই কিতাবে আছে হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ। অথচ মূল বিষয় এই যে, হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ সেটাও এবং এটাও। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ফকীহ ও লেখক হলেন শায়খ সাইয়েদ সাবেক আর ওখানে ফকীহ হলেন খায়রুল কুরূন বা তার নিকটতম যুগের মুজতাহিদ ইমাম আর লেখক হলেন পরবর্তী সময়ের কোনো ফকীহ বা আলেম।
যাই হোক, এ কিতাবের শুরুতে লেখক লেখেন,
أما بعد! فهذا الكتاب "فقه السنة" يتناول مسائل من الفقه الإسلامي مقرونة بأدلتها من صريح الكتاب وصحيح السنة، ومما أجمعت عليه الأمة ...
والكتاب في مجلداته مجتمعة يعطي صورة صحيحة للفقه الإسلامي الذي بعث الله به محمدا صلى الله عليه وسلم، ويفتح للناس باب الفهم عن الله وعن رسوله، ويجمعهم على الكتاب والسنة، ويقضي على الخلاف وبدعة التعصب للمذاهب، كما يقضي على الخرافة القائلة : بأن باب الاجتهاد قدسد.
উপরোক্ত কথায় যে চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলছি যে, তাঁর দাবি, এই কিতাবের মাসআলাগুলো সরাসরি কুরআনের আয়াত, সহীহ সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহর দলিল নির্ভর।
এ কিতাবটি যখন বর্তমান যুগের আলবানী (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর সামনে এল, যিনি চিন্তা-চেতনায় সাইয়েদ সাবেকের থেকে আলাদা নন, একই ঘরানার, আলবানীর কিতাবাদি; বিশেষত ‘ছিফাতুস সালাহ’র ভূমিকা পাঠ করলেই তা বোঝা যাবে।
আলবানী তার স্বভাব অনুযায়ী এই কিতাবটির সমালোচনা করার জন্য তা অধ্যয়ন করে এর উপর টীকা লিখেছে এবং ‘তামামুল মিন্নাহ ফিততালীক আলা ফিকহিস সুন্নাহ’ নামে চার শতাধিক পৃষ্ঠায় তা লিখেছে।
এতে আলবানী ফিকহুস সুন্নাহর মাত্র সিয়াম অধ্যায় পর্যন্ত টীকা লিখেছে, যা মূল কিতাবের চার ভাগের এক ভাগ। ১ রজব ১৪০৮ হিজরীর তথ্য অনুযায়ী আলবানী শুধু এটুকুরই টীকা লিখতে পেরেছে। অবশিষ্ট অংশের টীকা লেখার জন্য দুআ করেছে।
আলবানী ‘তামামুল মিন্নাহ’র ভূমিকায় ‘ফিকহুস সুন্নাহ’র ভুল-ত্র“টির প্রকার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সূচি উল্লেখ করেছে, যাতে চৌদ্দটি প্রকার রয়েছে।
নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল :
০১. সাইয়েদ সাবেক অসংখ্য যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।
০২. অন্যদিকে অনেক ‘ওয়াহী’ (মারাত্মক যয়ীফ) হাদীসকে শক্তিশালী বলেছেন।
০৩. কিছু হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন, অথচ তা সহীহ।
০৪. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতিতে হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ তাতে সে হাদীস নেই।
০৫. এমন কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন, যা হাদীসের কোনো কিতাবেই নেই।
০৬. যাচাই বাছাই ছাড়া কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে কোনো হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ খোদ ঐ কিতাবের লেখকই তাতে হাদীসটি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা তার সহীহ হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
০৭. কখনো কখনো দলিল ছাড়া মাসআলা উল্লেখ করেছেন, কখনো কিয়াসের ভিত্তিতে মাসআলা প্রমাণ করেছেন। অথচ সে বিষয়ে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। আবার কখনো সাধারণ দলিল উল্লেখ করেছেন, অথচ সেই মাসআলার সুনির্দিষ্ট দলিল রয়েছে।
০৮. কখনো কখনো এমন মত বা সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার প্রমাণ দুর্বল। অথচ বিপরীত মতটির দলিল শক্তিশালী।
০৯. সবচেয়ে আপত্তিকর কাজ এই যে, যে কিতাব সুন্নাহ মোতাবেক আমলের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য লেখা হয়েছে তাতে এমন অনেক মাসআলা আছে, যা সহীহ হাদীসের বিপরীত। অথচ ঐ সহীহ হাদীসগুলোর বিরোধী কোনো হাদীসও নেই।
আলবানী এর সব আপত্তি সঠিক নাও হতে পারে। তবে তার গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী তো ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় এ ধরনের অনেক ভুল রয়েছে।
আলবানীর তামামুল মিন্নাহ প্রকাশিত হওয়ার পরও শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু দু’/চারটি স্থান ব্যতীত তিনি ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় অন্য কোনো পরিবর্তন করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায়, তার দৃষ্টিতে আলবানী এর এই আপত্তিগুলো সঠিক নয়। কিংবা তা গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়।
এই দুই ব্যক্তিত্বের কেউই হানাফী নন। অন্য কোনো মাযহাবেরও অনুসারী নন।
দুজনই ছিলো হাদীসের আলেম এবং নির্ঘণ্ট ও কম্পিউটার যুগের আলেম। তারা উভয়েই উম্মতের সামনে তাঁদের মতে ‘ফিকহুল মাযাহিব’ স্থলে ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ পেশ করতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন এই যে, ফিকহি মতভিন্নতার প্রধান কারণ যদি শুধু এই হয় যে, যাদের মাঝে মতভিন্নতা হয়েছে তাদের একজন হয়তো হাদীস জানতেন না কিংবা হাদীস মানতেন না, অন্তত ঐ মাসআলার হাদীসটি তিনি জানতেন না তাহলে এই দুই শায়খের মাঝে এত বড় বড় এবং এত অধিক মাসআলায় মতভেদ কেন হল?
দ্বিতীয় উদাহরণ
______________
সম্প্রতি ১৪৩০ হি., মোতাবেক ২০০৯ ঈ. সালে ড. সাদ ইবনে আবদুল্লাহ আলবারীকের দুই খণ্ডের একটি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز رحمهم الله تعالى কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ শ’র অধিক।
কিতাবটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এই কিতাবে তিনি এমন কিছু মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যেসব মাসআলায় এ যুগের তিনজন সালাফী আলেম : শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায (১৩৩০-১৪২০ হি.), শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ ইবনে উছাইমীন (১৪২১ হি.) ও শায়খ (মুহাম্মাদ ইবনে নূহ) নাসিরুদ্দীন আলবানী (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর মাঝে মতভেদ হয়েছে।
কিতাবের নাম থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে, তিনজনের মাঝে যেসব মাসআলায় মতপার্থক্য হয়েছে তার সবগুলো লেখক এখানে উল্লেখ করেননি। তাছাড়া তিনি শুধু ‘কিতাবুর রাযাআ’ দুগ্ধপান অধ্যায় পর্যন্ত মাসআলাগুলো এখানে এনেছেন। এরপরও এতে মাসআলার মোট সংখ্যা দঁড়িয়েছে ১৬৬। আকীদা সংক্রান্ত কিছু মাসআলাও এতে রয়েছে, যেগুলো আকীদার মৌলিক নয়, শাখাগত মাসআলা এবং যার কিছু নমুনা উদ্ধৃতিসহ
البشارة والإتحاف بما بين ابن تيمية والألباني في العقيدة من الاختلاف
নামক পুস্তিকায়ও রয়েছে।
জেনে রাখা দরকার যে, ‘আলইজায’ কিতাবে ‘মাসাইলুল ইজতিহাদে’র উভয় প্রকারের মাসআলাই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কিছু মাসআলা এমন, যার কোনো শরঈ নস নেই অথবা শরঈ নস পাওয়া গেলেও তা থেকে সংশ্লিষ্ট মাসআলার বিধান আহরণ করতে হলে ইজতিহাদ প্রয়োজন।
তৃতীয় উদাহরণ
_______________
ড. বকর ইবনে আবদুল্লাহ আবু যায়েদ রিয়ায-এর পুস্তিকা ‘লা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’।
ইন্টারনেট সংস্করণ (তৃতীয় সংস্করণ) অনুযায়ী এতে তিনি নামাযের এমন আটটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যে সম্পর্কে কিছু সালাফী আলেমের ফতওয়া বা আমল তার দৃষ্টিতে প্রমাণহীন ও সুন্নাহবিরোধী।
চতুর্থ উদাহরণ
_____________
ড. ইউসুফ কারযাবী এর কিতাব ‘আলহালাল ওয়াল হারাম ফিলইসলাম’-এর সাথে ড. সালেহ ফাওযানের পুস্তিকা ‘আলই’লাম বিনাকদি কিতাবিল হালালি ওয়াল হারাম’ ও আলবানী-এর কিতাব ‘গায়াতুল মারাম ফী তাখরীজি আহাদীসিল হালালি ওয়াল হারাম’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
ফকীহ ইমামগণ কি হাদীস কম জানতেন?
কেউ কেউ মনে করেন যে, হাদীস সংকলন ও হাদীসের কিতাবসমূহ (যেমন প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব ইত্যাদি) সংকলনের উপরই হাদীসের জ্ঞান নির্ভর করে। এজন্য এসব কিতাব সংকলন হওয়ার আগে যেসব ইমাম ইন্তেকাল করেছেন তারা তাঁদের উপর হাদীস না জানা বা কম জানার অভিযোগ আরোপ করেন। অথচ এই ধারণাও ভুল। কেননা হাদীসের জ্ঞান নির্ভর করে হাদীস অন্বেষণ, হাদীস সংগ্রহের জন্য সফর এবং হাদীসের হিফয ও যবতের উপর।
যদি হাদীসের কিতাবসমূহের উপরই হাদীসের জ্ঞান নির্ভর করত তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এসব হাদীসগ্রন্থ কীভাবে সংকলিত হল?
ইবনে তাইমিয়া বলেন,
بل الذين كانوا قبل جمع هذه الدواوين كانوا أعلم بالسنة من المتأخرين بكثير ... فكانت دواوينهم صدورهم التي تحوي أضعاف ما في الدواوين. وهذا أمر لا يشك فيه من علم القضية.
(হাদীস ও সুন্নাহর) এই সব গ্রন্থ সংকলনের পূর্ববর্তী (ইমাম) গণ পরবর্তীগণের তুলনায় হাদীস ও সুন্নাহ অনেক বেশি জানতেন ...। তাদের গ্রন্থ তো ছিল তাদের সীনা, যাতে এইসব গ্রন্থের তুলনায় হাদীস ও সুন্নাহ অনেক অনেক গুণ বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত ছিল। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবগত কোনো ব্যক্তিই সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।
[সূত্রঃ মাজমূউল ফাতাওয়া ২০/২৩৯]।
যাদের ধারণা, পরবর্তী আলেমগণ পূর্ববর্তী আলেমগণের চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ তাদেরকে লক্ষ্য করে ইমাম বুখারী রাহ. বলেন,
قال معمر : أهل العلم كان الأول فالأول أعلم، وهؤلاء الآخر فالآخر عندهم أعلم.
মামার ইবনে রাশেদ রাহ. বলেন, আলেমগণের মধ্যে যিনি যত আগের অর্থাৎ যিনি নবী-যুগের যত নিকটবর্তী তিনি তুলনামূলক অধিক জ্ঞানী। অথচ এরা মনে করে, যিনি যত পরের তিনি তত জ্ঞানী।
[সূত্রঃ জুযউ রাফয়িল ইয়াদাইন ১০৭]।
বলাবাহুল্য, ইবনে তাইমিয়া ও মামার ইবনে রাশেদ-এর উল্লেখিত নীতিটির ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। তবে সাধারণ বাস্তবতা তা-ই, যা তাঁরা উল্লেখ করেছেন।
হাদীসের শরণাপন্ন হলে কি মতপার্থক্য দূর হয় না বিবাদ?
_______________
কারো কারো ধারণা, সবাই যদি কুরআন ও হাদীসের অনুসরণের ব্যাপারে সম্মত হয়ে যায় তাহলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে। ইখতিলাফ শুধু এ জন্যই হয় যে, একপক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে, অপরপক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে না।
এ প্রসঙ্গে তারা নিম্নোক্ত আয়াতটিও উল্লেখ করে থাকে,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
(তরজমা) যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট পেশ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখ। এটা উত্তম ও এর পরিণাম সুন্দর।
[সূরা নিসা (৫) : ৫৯]।
অথচ উপরোক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে। বরং বলা হয়েছে, বিবাদের ক্ষেত্রসমূহে কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হও। এর অর্থ হল তাহলে বিবাদ মিটে যাবে। এরা বিবাদ মিটে যাওয়াকে ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার সমার্থক ধরে নিয়েছে এবং এখানেই ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। কেননা বিবাদ মিটে যাওয়া ও ইখতিলাফ মিটে যাওয়া এক বিষয় নয়।
অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিবাদ মিটে যায়। পক্ষান্তরে অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ ও বিবাদ দু’টোই মিটে যায়। যেমন বিবাদরতদের মাঝে এক পক্ষ জালিম, অপর পক্ষ মাজলূম। এক পক্ষ হকের উপর, অন্য পক্ষ বাতিলের উপর। তারা যদি কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় এবং কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেয় তাহলে বিবাদও দূর হবে, মতভেদও থাকবে না। পক্ষান্তরে যেখানে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে একাধিক মত হয়েছে কিংবা সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে একজন এক সুন্নাহ অন্যজন অন্য সুন্নাহ অনুসরণ করছে, এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি পরস্পর বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় তাহলে কিতাব-সুন্নাহ তাদেরকে এই নির্দেশনাই দিবে যে, বিবাদ করো না। কারণ তোমরা উভয়ে সঠিক পথে আছ। কারো অধিকার নেই অন্যের উপর আক্রমণ করার। তো এখানে মতপার্থক্য বহাল থাকা সত্ত্বেও বিবাদ দূর হবে।
সহীহ বুখারীর ঐ হাদীস কারো অজানা নয়, যে হাদীসে হযরত উমর রা. ও হযরত হিশাম ইবনে হাকীম রা.-এর মধ্যকার বিরোধের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা সাময়িক ঝগড়ার রূপ ধারণ করেছিল। মতবিরোধটি হয়েছিল কুরআনের কিরাত নিয়ে।
হযরত উমর রা. হযরত হিশাম রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাজির করে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকের পড়া শুনলেন এরপর প্রত্যেককেই বললেন,
هكذا أنزلت
অর্থাৎ এভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে।
[সূত্রঃ সহীহ বুখারী ৮/৬৩৯-৬৪০ (ফাতহুল বারী)]।
এ ধরনের আরেকটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন,
كلاكما محسن، فاقرآ
তোমাদের দুজনই ঠিক পড়েছ। তাই পড়তে থাক।
[সূত্রঃ সহীহ বুখারী ৮/৭২০ (ফাতহুল বারী)]।
বনু কুরাইজার ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ হয়েছিল। উভয় দল হাদীসের মর্ম যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এরপর সরাসরি আল্লাহর রাসূলের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো দলকে তিরস্কার করেননি। বিস্তারিত ঘটনা উদ্ধৃতিসহ সামনে আসছে।
তো দেখুন, প্রথম ঘটনা ছিল কিরাআতের পার্থক্য সংক্রান্ত, যা সুন্নাহর বিভিন্নতার মধ্যে শামিল। এই মতভেদের ক্ষেত্রে যখন আল্লাহর রাসূলের শরণ নেওয়া হল তিনি বিবাদ মিটিয়ে দিলেন, কিন্তু ইখতিলাফ বহাল রাখলেন এবং বললেন, উভয় পদ্ধতি সঠিক।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল রায় ও ইজতিহাদের মতপার্থক্য।
এখানে প্রত্যেক পক্ষ হাদীস থেকে যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এখানে তাদের মাঝে কোনো বিবাদ হয়নি। এরপরও তাঁরা বোধ হয় এজন্যই আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, তাঁর আদেশের সঠিক অর্থ জানবে না। কিন্তু হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূল তা বলেননি। শুধু এটুকু করেছেন যে, কোনো পক্ষকেই তিরস্কার করেননি। তাহলে এখানে তিনি ইজতিহাদ এবং সঠিক প্রেরণা তথা হাদীস অনুসুরণের প্রেরণা থেকে প্রকাশিত সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছেন। এই শ্রেণীর মতভেদকে তিনি বাতিল করেননি। তাহলে ইখতিলাফে মাহমূদ বা ইখতিলাফে মাশরূ, যে নামই দেওয়া হোক, কুরআন-সুন্নাহর সামনে উপস্থাপন করা হলে বিলুপ্ত হবে না। কারণ এ তো কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতেই হয়েছে। হ্যাঁ, এসব বিষয়ে কেউ যদি বিবাদে লিপ্ত হয় সে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হলে বিবাদ থেকে ফিরে আসবে। কারণ কুরআন তাকে বলবে,
وكلا آتينا حكما وعلما
আর তাদের প্রত্যেককে দিয়েছি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান।
এবং হাদীস তাকে বলবে,
كلاكما محسن فاقرءا এবং فما عنف واحدا من الفريقين
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরণাপন্ন হওয়ার ফলে ঝগড়া তো মিটল বটে, কিন্তু মতভিন্নতা মিটেনি। এজন্যই মিটেনি যে, এ মতভিন্নতা ইখতিলাফে মাহমুদ বা প্রশংসিত মতভিন্নতার অন্তর্ভুক্ত। আর প্রশংসিত বা অনুমোদিত মতভিন্নতার উদ্দেশ্য একমাত্র দলিলের অনুসরণই হয়ে থাকে, দলিলের বিরোধিতা নয়।
তাই এসব ক্ষেত্রে এ ধরনের উক্তি একেবারে অবান্তর যে, দলিলের শরণাপন্ন হলেই ইখতিলাফ মিটে যাবে।
হ্যাঁ, ইখতিলাফে মাযমুম বা নিন্দিত মতভেদের ভিত্তি যেহেতু দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা অথবা মূর্খতা ও হঠকারিতা কিংবা প্রবৃত্তি ও দুর্বল ধারণার অনুসরণের উপর তাই এ ধরনের ইখতিলাফ কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন ও অনুসরণের দ্বারা মিটে যায়।
পক্ষান্তরে ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ হয়েই থাকে কুরআন ও হাদীসের উপর অটল থাকার কারণে। তাই কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে এ ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এজন্য এ ধরনের ইখতিলাফ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের মাঝেও হয়েছে এবং পরবর্তীতে ফির্কায়ে আহলে হাদীস ও সালাফী ফির্কার উলামাদের মাঝেও হয়েছে।
যারা আসবাবে ইখতিলাফে ফুকাহা এবং ফিকহে মুকারান-এর কিতাবসমূহের সঠিক ধারণা রাখেন তাদের নিকট বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব সত্য, তবে কিছু কিছু মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের ইখতিলাফকে হাদীস মানা বা না মানার ইখতিলাফ বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়।
মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো আয়াত বা হাদীস থাকলেই কি তা ইজতিহাদের উর্ধ্বে চলে যায়?
অনেকে এ কথা তো মানে যে, যে সমস্ত মাসআলার মধ্যে ইজতিহাদের অবকাশ আছে সেগুলোতে অন্য পক্ষের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি এবং তাতে নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা ঠিক নয়। কিন্তু পরক্ষণে তারা আরেকটি ভুলের মধ্যে পতিত হয়। তা হচ্ছে, কোনো মাসআলায় একটি আয়াত বা হাদীস পেলেই (যদিও আয়াতটি মুহকাম বা মুফাসসার নয় এবং হাদীসের সহীহ হওয়ার বিষয়টি মুজমা আলাইহি তথা সর্বসম্মত নয় বা হাদীসের মর্মের বিষয়টি অকাট্য নয় তাদের নিকট ঐ মাসআলা ইজতিহাদের উর্ধ্বে চলে যায়। তাদের ধারণায় ঐ মাসআলাটি এমন ‘মানসূস আলাইহি’ হয়ে যায় যে, কেউ যদি এতে মতবিরোধ করে তাহলে এজন্যই করবে যে, সে হয়তো উক্ত আয়াত ও হাদীসের সন্ধান পায়নি কিংবা পেলেও তা মানতে চায় না।
এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ উসূলে তাফসীর বা তাফসীরের মৌলিক নীতিমালাসমূহের প্রতি যথার্থ লক্ষ্য রেখে তাফসীরের গ্রহণযোগ্য উৎস থেকে কুরআন বুঝার চেষ্টা করলেও মুহকাম বা মুফাসসার নয় এমন আয়াতের অর্থ বুঝা বা তা থেকে বিধান বের করার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে।
এজন্যই খোদ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণের মাঝে এবং খায়রুল কুরূনের মনীষীগণের মাঝে কুরআন বোঝা এবং কুরআন থেকে হুকুম-আহকাম উদঘাটন করার ক্ষেত্রে অনেক স্থানে মতবিরোধ হয়েছে। তাফসীরের নির্ভরযোগ্য কিতাব এবং আহকামুল কুরআন বিষয়ক কিতাবসূমহে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে।
এমনিভাবে কোনো মাসআলার ক্ষেত্রে কোনো হাদীস পাওয়া গেলেই মাসআলাটি ইজতিহাদের সীমারেখা থেকে বের হয়ে যায় না; বরং তখনই বের হয় যখন হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে সহীহ বলে প্রমাণিত হবে। সাথে সাথে হাদীসটির মর্মার্থ এতই স্পষ্ট হবে যে, ভাষাগত নিয়মাবলি ও উসূলে ফিকহের দৃষ্টিতে তাতে একাধিক অর্থের অবকাশ নেই এবং তা অন্য কোনো শরঈ দলিলেরও বিরোধী হবে না। কেননা যেসব হাদীস ‘আখবারে আহাদ’-এর অন্তর্ভুক্ত তার যাচাই-বাছাই, একাধিক অর্থের অবকাশ রাখে এমন জায়গায় হাদীসের অর্থ নির্ধারণ এবং ‘মুখতালিফুল হাদীস’ তথা বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে রাজেহ ও মারজুহ নির্ধারণ ইজতিহাদ ছাড়া অন্য উপায়ে সম্ভব নয়। কারণ এসব বিষয়ের সমাধান তো কুরআন-হাদীসে উল্লেখ নেই।
তাই এমতাবস্থায় কোনো মাসআলায় ছুবুত ও দালালত তথা মর্ম ও প্রামাণ্যতার দিক থেকে অকাট্য নয় এমন কোনো হাদীস থাকলেও তা মুজতাহাদ ফী মাসআলাই থেকে যায় এবং সেখানে ইজতিহাদের অবকাশ থাকে। এজন্যই শত শত মাসআলা এমন পাওয়া যায়, যেগুলোর ব্যাপারে হাদীস থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণের মাঝে মতপার্থক্য হয়েছে। শুধু জামে তিরমিযী অধ্যয়ন করলেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর বর্তমান সময়ের আকাবির সালাফী উলামাদের মাঝে মতভিন্নতাপূর্ণ মাসআলা সংক্রান্ত যে কয়েকটি কিতাবের নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হল সেগুলো অধ্যয়ন করলেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
_________________