আপনারা সকলে জানেন, বিশেষ করে মক্কা মুকাররামায় মসজিদে হারামে এবং মদীনা মুনাওওয়ারায় মসজিদে নববীতে রামাদান মাসে খতমে তারাবীহ/ খতমে কোর’আনের পর ইমাম সাহেব নামাজের ভেতর দীর্ঘ দোয়া করে থাকেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সালাতে খতমে কোর’আনের পর এভাবে দোয়া করার দলীল কী? এরকম দোয়া কি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন?
উত্তরঃ জী না। করেন নাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম দোয়া কি সাহাবায়ে কেরাম করেছেন?
উত্তরঃ জী না। কোন প্রমাণ নেই।
মূলতঃ এই উত্তরগুলো কিন্তু লা-মাযহাবীদের শয়েখদের নিকট থেকে সংগ্রহ করে বলছি। তার মানে এটা লা-মাযহাবী, নামধারী আহলে হাদীসদের নিকট পরিস্কার বেদ’আত।
সউদী গ্র্যান্ড মুফতী বিন বাযের ফতোয়াঃ
সঊদী আরবের ফতোয়া বিভাগের সাবেক প্রধান মুফতী, লা-মাযহাবীদের এই দাবী মেনে নিয়েই তারপর ফতোয়া দিয়েছেন, যদিও এর প্রমাণ সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে নেই, তবুও এটি মুসতাহাব।
বিন বায তাঁর ফতোয়ায় বলেছেন,
فالحاصل أن هذا لا بأس به إن شاء الله ولا حرج فيه بل هو مستحب لما فيه من تحري إجابة الدعاء بعد تلاوة كتاب الله عز وجل،
মোট কথা হচ্ছে, সালাতে খতমে কোর’আনের পর দোয়া করাতে কোন অসুবিধা নেই। ইনশা আল্লাহ। এতে কোন বাধাও নেই বরং এটা মুসতাহাব। কারণ, কোর’আন তেলাওয়াতের পর দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়।
এরপর তিনি বলেছেন,
وإنما الكلام إذا كان في داخل الصلاة، أما في خارج الصلاة فلا أعلم نزاعاً في أنه مستحب الدعاء بعد ختم القرآن، لكن في الصلاة هو الذي حصل فيه الإثارة الآن والبحث فلا أعلم عن السلف أن أحداً أنكر هذا في داخل الصلاة
কথা হচ্ছে নামাজের ভেতরে দোয়া নিয়ে। নামাজের বাইরে এমন খতমে কোর’আনের পর দোয়া যে মুসতাহাব-এটা নিয়ে আমি কোন ইখতেলাফ আছে বলে আমি জানিনা।
কিন্তু নামাজের ভেতরে এমন দোয়া, যা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, আমি জানিনা, সালাফে সালিহীনের কেউ নামাজের ভেতরে এটাকে অস্বীকার করেছেন।
এরপর তিনি বলেছেন,
لأن الدعاء مشروع في الصلاة وخارجها
কেননা নামাজের মধ্যে ও বাইরে আমভাবে দোয়া করা শরীয়ত সম্মত।
এরপর তিনি বলেছেন,
وجنس الدعاء في الصلاة معروف من النبي عليه الصلاة والسلام في صلاة الليل فينبغي أن يكون هذا من جنس ذاك.
রাতের নামাজে, নামাজের ভেতরে দোয়া করা রাসুল সাল্লাল্লাহু লাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মা’রূফ। (দলীল বিদ্যমান) সুতরাং তারাবীহর সালাতে খতমে কোর’আনের পর দোয়া ও সেই দোয়ার অন্তর্ভুক্ত।
রেফারেন্সঃ
ফাতাওয়া বিন বায- ৩০/৩৫
মাজমু উ ফাতাওয়া ওয়ার রাসাইল- ১৩তম খন্ড
ফতোয়াটির পর্যালোচনা এবং নামাজের পর সম্মিলিত দোয়াঃ
______________________
খতমে কোর’আনের পর যে দোয়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম করেন নাই, সেটাকে মুফতী বায মুসতাহাব বলে ফতোয়া দিয়েছেন যেসব কারণেঃ
প্রথম কারণঃ
কোর’আন তেলাওয়াতের পর দোয়া কবুল হয়, তাই এমন খতমে কোর’আনের পর দোয়া করা মুসতাহাব।
* ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া-
এই যদি মুসতাহাব হওয়ার দলীল হয়ে থাকে। তবে একই দলীলে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া ও মুসতাহাব হয়।
কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عن أبي أمامة قال قيل لرسول الله صلى الله عليه سلم : أي الدعاء أسمع قال جوف الليل الآخر ودبر الصلوات المكتوبات
হযরত আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন দোয়া অধিক মকবুল হয় (আল্লাহর দরবারে)? তিনি বললেন, শেষ রাতে এবং ফরজ নামাজের পর।
রেফারেন্সঃ
তিরমিযি-৫/৫২৬, ইমাম তিরমিযি বলেছেন, হাদীসটি হাসান।
দ্বিতীয় কারণঃ
সালফে সালিহীন এমন দোয়াকে অস্বীকার করেন নাই, তাই এটা মুসতাহাব।
* ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া-
এই যদি নামাজে খতমে কোর’আনের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া মুসতাহাব হওয়ার দলীল হয়, তবে একই দলীলে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া ও মুসতাহাব হবে। কারণ সাহাবীগণ ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া করেছেন। মাকামে ইবরাহীমের পেছনে প্রতিদিন ফজর নামাজের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া হত। সাহাবায়ে কেরাম উপস্থিত থাকতেন। যেমনটি বিখ্যাত ইমাম ফাকিহী তাঁর আখবারু মাক্কাহ তে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া আলা বিন হাদরামী রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবাদেরকে নিয়ে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া করেছেন, যেমনটি লা-মাযহাবী স্কলার ডক্টর তাঁর ফুরসানুন নাহারে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও আরো বিভিন্ন কিতাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
কোন সাহাবায়ে কেরাম এমন সম্মিলিত ভাবে দোয়া করার প্রতিবাদ করেন নাই, অস্বীকার করেন নাই।
তাই নিঃসন্দেহে এটিও মুসতাহাব বলে প্রমাণিত হলো।
তৃতীয় কারণঃ
নামাজের ভেতরে এবং বাইরে আমভাবে দোয়া শরীয়ত সম্মত। তাই এটা মুসতাহাব।
* ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া-
এই যদি নামাজে খতমে কোর’আনের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া মুসতাহাব হওয়ার দলীল হয়, তবে একই দলীলে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া মুসতাহাব হবে। অনেক দলীল রয়েছে। প্রথম কারণের আলোচনায় তিরমিযীর হাদীসটি তন্মধ্যে একটি।
সুতরাং এই কারণের উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া মুসতাহাব।
চতুর্থ কারণঃ
যেহেতু নামাজের ভেতর দোয়ার “জিনস” টি প্রমাণিত। তাই খতমে কোর’আনের পর নামাজের ভেতর সম্মিলিতভাবে দোয়া করা শরীয়ত সম্মত দোয়ারই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। আর তাই এটি মুসতাহাব।
* ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া-
জী, এই যদি নামাজের ভেতর খতমে কোর’আনের পর সম্মিলিত ভাবে দোয়া মুসতাহাব হওয়ার দলীল হয়, তবে একই দলীলে ফরজ নামাজের পরও সম্মিলিত ভাবে দোয়া মুসতাহাব হবে।
কারণ ফরজ নামাজের পর দোয়ার “জিনস” সম্পূর্ণ ভাবে প্রমাণিত। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তাই সহীহ বুখারীতে একটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন, বাবুদ দোয়া ই বা’দাত তাসলীম। অর্থাৎ নামাজে সালাম ফেরানোর পর দোয়ার অধ্যায়। আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ এ অধ্যায়ের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ইমাম বুখারীর এই নামকরণ, এ অধ্যায় ঐ সকল লোকদের প্রতি জবাব যারা ফরজ নামাজের পর দোয়াকে অস্বীকার করে। দেখুন ফাতহুল বারী।
তাহলে, মুফতী বাযের ফতোয়ায়, নামাজের ভেতর দোয়ার “জিনস” টি প্রমাণিত হওয়ায় খতমে কোর’আনের পর নামাজের ভেতর সম্মিলিতভাবে দোয়া করা শরীয়ত সম্মত দোয়ারই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত হলে ঠিক অনুরূপভাবে ফরজ নামাজের পর দোয়ার “জিনস” টি প্রমাণিত হওয়ায় ফরজ নামাজের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া করাও শরীয়ত সম্মত দোয়ারই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।