ইমাম হবেন যিনিঃ আল্লাহর দোস্তের প্রাণপ্রিয় নাতি হাসান-হুসাইন (রাঃ) জান্নাতী যুবকদের সর্দার।

আল্ হাল হামদুলিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্, আম্মা বাদ:
ইমাম ও ইমামত ইসলাম ধর্মের এবং মুসলিম সমাজের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল প্রয়োজনীয় বিষয়। একটি দেশ থেকে নিয়ে একটি গ্রাম পর্যন্ত এমনকি একটি পরিবারেও এই পদের প্রয়োজনীয়তা লক্ষণীয়।
তাই এই বিষয়টির সম্পর্কে আমাদের সমাজের প্রত্যেক ইমামকে বিশেষ ভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমদের সাধারণ ভাবে জ্ঞান রাখা আবশ্যক।

ইমাম শব্দের আভিধানিক অর্থঃ
আরবী ভাষার বিশিষ্ট অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ উল্লেখ হয়েছে, ‘মানুষ যার অনুসরণ করে, তাকে ইমাম বলে’।
ইবনু সীদাহ বলেন,
‘প্রধান ব্যক্তি কিংবা মানুষের অনুকরণীয় ব্যক্তিকেই ইমাম বলা হয়। এর বহুবচন হচ্ছে, ‘আইম্মাহ’-ইমামগণ।
[সূত্রঃ লিসানুল আরব, ইবনে মনজুর, ১২/২৪।]

ফিকাহ বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ইমাম তাকেই বলা হয় কোন সম্প্রদায় যার অনুসরণ করে। সেই সম্প্রদায় সঠিক পথের অধিকারী হোক অথবা পথ ভ্রষ্ট হোক হোক।
ক্বুরআ'নুল কারিমে উভয় প্রকার ইমামত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন।
যেমন-
১/
সঠিক পথের অধিকারী অর্থে আল্লাহ বলেছেন:
“আর তাদের বানিয়েছিলাম ইমাম (নেতা) তারা আমার নির্দেশে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত।”
[সুরা আম্বিয়া; আয়াত ৭৩।]

২/
পথ ভ্রষ্ট অর্থে:
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“আমি তাদের ইমাম (নেতা) করেছিলাম। তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত, কিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।”
[সুরা কাসাস; আয়াত ৪১।]
দেখুন- ফিকহ্ বিশ্বকোষ, ৬/২১৬-২১৭।

আর ইমামাহ্-প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা ইমামতি বলি- তা আরবী আম্মা-ইয়াউম্মু শব্দের মাসদার বা উৎস, যার আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা। শব্দটি অগ্রবর্তী হওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। আরবী ভাষায় বলা হয়, আম্মাহুম এবং আম্মা বিহিমঃ অর্থাৎ যখন সে অগ্রবর্তী হয়।
[ফিকাহ্ বিশ্বকোষ, ৬/২০১]

ইমামতির পারিভাষিক অর্থ:
ফকীহ তথা ইসলামী বিদ্বানগণের পরিভাষায় ইমামত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা:
ইমামা কুবরা (বড় ইমামত)
ইমামা সুগরা (ছোট ইমামত)।

ইসলামী পরিভাষায় বড় ইমামত হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিনিধি হিসাবে দ্বীন ও দুনিয়ার সাধারণ নেতৃত্ব প্রদানকরা। [সূত্রঃ ফিক্বাহ্ বিশ্বকোষ, ৬/২১৬] যাকে খলীফা, রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশের প্রধান নেতা বলা যেতে পারে।

আর ছোট ইমামত হচ্ছে নামাযের ইমামত। যে ব্যক্তি নামাযের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয় আর নামাযীরা তাঁর অনুকরণ করে থাকে। যেহেতু তিনি অনুকরণীয় এবং অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সেহেতু তাঁকে ইমাম বলা হয়।

অবশ্য ইমাম শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শব্দটির আভিধানিক অর্থকে কেন্দ্র করে এমন ব্যক্তিকেও ইমাম বলা হয়, যে বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী এবং সেই জ্ঞানে সে অনুকরণীয়।
তাই হাদীস শাস্ত্রে বুখারী (রহ) কে ইমাম বুখারী বলা হয়। ফিকাহ শাস্ত্রে আবু হানীফা, মালেক, শাফেয়ী ইত্যাদি উলামাগণের নামের শুরুতে ইমাম লেখা হয়। এ সবই এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহারের উদাহরণ।

ইমামতি করা দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা জীবন করে গেছেন। অতঃপর তাঁর ওফাত শরীফের পর চার খলীফা তা সম্পাদন করেছেন এবং এখনও মুসলিম সমাজের উত্তম ব্যক্তিরাই সাধারণত: সেই উত্তম কাজটি পালন করে থাকেন।

ইমামতীর অধিক হকদার কে?

এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ

يَؤمُّ القومَ أقرئهم لكتابِ اللهِ، فإن كانوا في القراءةِ سواء فأعلمهم بالسنة فإن كانو في السنة سواء فأقدمهم هجرة، فإن كانوا في الهجرة سواء فأقدمهم سلما، ولا يؤَمَّنَّ الرجلُ الرجلَ في سلطانه، و لا يقعد في بيته على تكرمته إلا بإذنه” [رواه مسلم]

অর্থাৎঃ “লোকদের ইমামতি করবে ঐ ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব সব চেয়ে বেশী পাঠ করতে পারে। যদি তারা পাঠ করার ক্ষেত্রে সমমানের হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সুন্নতের অধিক জ্ঞানী হবে সে ইমামতি করবে। যদি সুন্নতের জ্ঞানে সকলে বরাবর হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম হিজরতকারী সে ইমামতি করবে। যদি তারা সকলে হিজরতের ক্ষেত্রেও বরাবর হয় তবে তাদের মধ্যে আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে সে তাদের ইমাতি করবে। কোন ব্যক্তি যেন কোন ব্যক্তির অধীনস্থ স্থানে তার অনুমতি ব্যতীত ইমামতী না করে এবং কোন ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত আসনে যেন তার অনুমতি ব্যতীত না বসে”।
[সূত্রঃ মুসলিম, অধ্যায়, মাসাজিদ এবং নামাযের স্থান সমূহ, হাদীস নং ৬৭৩।]
সহীহ মুসলিমে এই বর্ণনার ঠিক পরের বর্ণনায় আগে ’ইসলাম গ্রহণের স্থানে বয়সে বড় শব্দটি এসেছে।
উপরের বর্ণনানুযায়ী ইমামতির বেশী হকদার ব্যক্তিবর্গের ধারাবাহিকতা এইরূপঃ

০১- কুরআন সব চেয়ে বেশী পাঠকারী। এখানে সব চেয়ে বেশী পাঠকারী বলতে যার কুরআন সব চাইতে বেশী মুখস্থ আছে তাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ আমর বিন সালমার হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদেশ এই ভাবে উল্লেখ হয়েছে, “যখন নামাযের সময় হবে, তখন তোমাদের মধ্যে কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যে যার অধিক কুরআন মুখস্থ আছে সে ইমামতি করবে’’।
[সূত্রঃ বুখারী, অধ্যায়, মাগাযী, হাদীস নং ৪৩০২।]

০২- সকলে কুরআন মুখস্থের ক্ষেত্রে সমান হলে সুন্নতের ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী।
০৩- সুন্নতের জ্ঞানেও সকলে বরাবর হলে যে ব্যক্তি কুফরের দেশ হতে ইসলামের দেশে আগে হিজরতকারী।

০৪- হিজরতের ক্ষেত্রে সকলে বরাবর হলে, যে ইসলাম গ্রহণে অগ্রবর্তী।

০৫- আর ইসলাম গ্রহণে সবাই বরাবর হলে, যে বয়সে বড়। যেমন সহীহ মুসলিমের পরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
উপরে বর্ণিত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের তরতীব নির্ণয়ে বিভিন্ন উলামা ও মাজহাবের কিছু মতভেদ থাকলেও হাদীসে বর্ণিত ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পাবে। তবে চতুর্থের স্থানে পঞ্চম হওয়ার সম্ভাবনা হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। অর্থাৎ হিজরতের দিক দিয়ে সকলে বরাবর হলে বয়সে বড় বেশী হকদার না ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী হকদার? এ বিষয়ে হাদীসের শব্দের ধারাবাহিকতায় পার্থক্য দেখা যায়। তাই কেউ বয়সে বড়কে প্রাধান্য দিয়েছে আর কেউ ইসলাম আগে গ্রহণকে প্রাধান্য দিয়েছে।
[সূত্রঃ শারহু মুসলিম,৫ম খণ্ড, ১৭৫-১৭৭/ আর রাওযা আন নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ সিদ্দীক হাসান খান, ১/৩২০/ মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৩/১১১৬।]

হাদীসে বর্ণিত উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যে যদি সকলে সমান হয়, তাহলে কী করতে হবে? এ বিষয়ে সেই হাদীসে আরো কিছু বলা হয় নি। তবে অন্যান্য দলীলের আলোকে ইসলামী পণ্ডিতদের অনেকে মনে করেন, তাহলে তাদের মধ্যে অধিক পরহেজগার ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে। কারণ আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
“অবশ্যই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ ভীরুই বেশী সম্মানীয়।”
[সুরা আল হুজুরাত; আয়াত ১৩।]
কাজেই যে কোন যুগে, যে কোন কালে বা যে কোন স্থানে সম্মানীয় হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাধিক আল্লাহ্ ভীরু ব্যক্তিই সে যুগে বা স্থানে প্রাধান্যতা লাভ করবে, যা ক্বুরআ'নুল কারিম দ্বারাই অনিবার্য সাব্যস্থ হয়।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হাদিস শরীফে উল্লেখিত হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এঁর মর্যাদা ও তাঁর অতুলনীয় পরহেজগারীতার কারণে তিনিই ছিলেন তৎকালে আল্লাহর বান্দাদের জন্যে তাদেরই ইমামাতের সর্বোৎকৃষ্ট অধিকারী।
কিন্তু তৎকালে ইসলামের দুষমন ইহুদী গং পথভ্রষ্ট এজিদের ছত্রছায়ায় ইসলামকে চিরতরে নির্মূলের ফাঁদ আঁটে।

পথভ্রষ্ট এজিদ ইমাম হুসাইন (রাঃ) এঁর মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করে। শিশু সন্তানসহ স্বপরিবারে সফররত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এঁর উপর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সৈন্য বহর প্রেরণ করে শহীদ করে দেয়।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হচ্ছেন জান্নাতী সকল যুবকদের সাইয়্যিদ; আর অতুলনীয় স্বীয় পরহেজগারীতার জন্যে তিনি সর্বযুগের অনুসরনীয় ইমাম।

নিম্নে হযরত ঈমাম হুসাইন (রাঃ) এঁর মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

বৃদ্ধাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেও জান্নাতের সকল বাসিন্দা বৃদ্ধ থাকবে না, সকলেই যুবক হবে, আর হযরত হাসান রা. ও হযরত হুসাইন রা. হবেন জান্নাতী যুবকদের সাইয়্যিদ ও অনুসরনীয় ইমামঃ

প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

»يُنَادِي مُنَادٍ: إِنَّ لَكُمْ أَنْ تَصِحُّوا فَلَا تَسْقَمُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَحْيَوْا فَلَا تَمُوتُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَشِبُّوا فَلَا تَهْرَمُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَنْعَمُوا فَلَا تَبْأَسُوا أَبَدًا«

অর্থাৎঃ ‘যখন জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন এক ঘোষক ঘোষণা করবে- ‘‘হে জান্নাতীগণ! এখন আর তোমরা কোনোদিন অসুস্থ হয়ে পড়বে না। সর্বদা সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান থাকবে। কোনোদিন আর তোমাদের মৃত্যু হবে না, অনন্তকাল জীবিত থাকবে। সর্বদা যুবক হয়ে থাকবে কখনো বুড়ো হবে না। সর্বদা অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করবে কোনোদিন তা শেষ হবে না এবং কখনো দুঃখ ও অনাহারে থাকবে না।’
[সূত্রঃ মুসলিম, ২৮৩৭; তিরমিযী, ৩২৪৬।]

প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
“আলহাসানু ওয়াল হুসাইনি সায়্যিদা শাবাবি আহলিল জান্নাহ”- এ হাদীসটি তিন ধরণের শব্দে একাধিক সাহাবী রাঃ থেকে বর্ণিত। উক্ত শব্দে বর্ণিত মুবারাক হাদিসটি জামে সাগীর গ্রন্থে এসেছে। তাতে নিম্নবর্ণিত সাহাবী রাঃ এঁর উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন-
০১- হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ।
[সূত্রঃ মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজী।]
০২- হযরত উমর রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৩- হযরত আলী রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৪- হযরত জাবের রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৫- হযরত আবু হুরায়রা রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৬- হযরত উসামা বিন জায়েদ রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল আওসাত।]
০৭- হযরত বারা বিন আযেব রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল আওসাত।]
০৮- হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ।
[সূত্রঃ আজামেউস সাগীর, হাদীস নং-৩৮২০।]

আরেকটি হাদীসের শব্দ হল
الحسن والحسين سيدا شباب اهل الجنة وأبوهما خير منهما
তথা হাসান ও হুসাইন হল জান্নাতের যুবকদের সর্দার এবং তাদের উভয়ের পিতা হলেন তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
এর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে-
০১- ইবনে ওমর রাঃ
[সূত্রঃ ইবনে মাজাহ, মুস্তাদরাকে হাকেম]
০২-কারাহ বিন আয়াছ রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৩- মালিক বিন হুয়াইরিস রাঃ।
[সূত্রঃ আলমুজামুল কাবীর।]
০৪- ইবনে মাসউদ রাঃ।
[সূত্রঃ মুস্তাদরাকে হাকেম।]
আরেক শব্দে রয়েছে
الحسن والحسين سسدا شباب اهل الجنة الا ابنى الخالة عيسى بن مريم ويحيى بن زكريا وفاطمة سيدة نساء اهل الجنة الا ماكان من مريم بن عمران،

অর্থাৎঃ হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন জান্নাতের যুবকদের সর্দার দুই খালাত ভাই হযরত ঈসা বিন মারইয়াম ও হযরত ইয়াহইয়া বিন জাকারিয়া ব্যতিত। আর হযরত ফাতিমা রাঃ জান্নাতী মহিলাদের সর্দার বা সাইয়্যিদা হবেন হযরত মারিয়ম বিন ইমরান ছাড়া।
এ বর্ণনাটি হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে মুসনাদে আহমাদ, সহীহ ইবনে হিব্বান, মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুজামে কাবীর, মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত।
আর মাজমাউয যাওয়ায়েদে এ হাদীসটি হযরত হুজাইফা বিন ইয়ামান এবং হযরত হুসাইন রাঃ থেকে বর্ণিত।
[সূত্রঃ মাযমাউজ যাওয়ায়েদ-৯/১৮৩-১৮৪।]
উক্ত বিস্তারিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা গেল, উক্ত হাদীসটি তেরজন সাহাবী থেকে বর্ণিত। যার মাঝে কিছু হাদীস সহীহ। কিছু জঈফ এবং কিছু হাসান পর্যায়ের।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে উক্ত হাদীসটি সন্দেহাতীতভাবে সহীহ।
হাফেজ সুয়ুতী রহঃ এ হাদীসকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
[সূত্রঃ ফাইজুল কাদীর শরহে জামে সাগীর-৩/৪১৫।]

আম্বিয়াগণ (আঃ)-ও শামিল কি নাঃ
হাদীসে এসেছে হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) জান্নাতী যুবকদের সর্দার হবেন। যারা যুবক অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন, তাদের সর্দার হবেন হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন রাঃ। আর কোন নবীই যুবক অবস্থায় ইন্তেকাল করেননি। সবাই যৌবন পাড় করে প্রৌঢ় অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। একই অবস্থা বড় বড় সাহাবীদের। তাই এ হাদীস দ্বারা নবী ও ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (রাঃ) থেকে বড় সাহাবীদের কথা বলা হয়নি। আর হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রাঃ নবীগণ এবং বয়স্ক ও মুরুব্বী সাহাবীদের সর্দারও হবেন না। কেবলি যুবক অবস্থায় ইন্তেকাল করা ব্যক্তিদের সর্দার হবেন।

হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা জান্নাতি বয়স্কদের সরদারঃ

হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ঐ সমস্ত জান্নাতিদের সরদার হবেন, যারা বয়স্ক বয়সে ইন্তেকাল করেছেন।
প্রমাণ-

عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍرضي الله عنه قَالَكُنْتُ مَعَ رَسُولِ اللهُصلى الله عليه وسلمإِذْ طَلَعَ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ فَقَالَ رَسُولَ اللهُ صلى الله عليه وسلم«هَذَانِ سَيِّدَا كُهُولِ أَهْلِ الْجَنَّةِ مِنْ الْأَوَّلِينَ وَالْآخِرِينَ إِلَّا النَّبِيِّينَ وَالْمُرْسَلِينَ يَا عَلِيُّ لَا تُخْبِرْهُمَا»

অর্থাৎঃ “আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সাথে ছিলাম হঠাৎ করে আবু বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাও চলে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবললেন, তারা উভয়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণকারী মুসলিমদের সরদার হবে- তারা পূর্ববর্তী উম্মতের লোক হোক আর পরবর্তী উম্মতের। তবে নবী রাসূলগণ ব্যতীত। হে আলী, তুমি এ সংবাদ তাদেরকে দিও না।”
[সূত্রঃ তিরমিযী, মানাকেব অধ্যায়, হাদিস ২৮৯৭।]

হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা জান্নাতে যুবকদের সর্দারঃ

হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা জান্নাতে ঐ সমস্ত লোকদের সরদার হবে যারা যৌবনকালে মৃত্যুবরণ করেছে।
প্রমাণ-

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّرضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولَ اللهُ صلى الله عليه وسلم«الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ»

অর্থাৎঃ “হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হাসান হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা জান্নাতি যুবকদের সরদার হবে।
[সূত্রঃ তিরমিযী, হাদিস ৩৭৪১; ইবনে মাযাহ হাদিস ১১৮।]

“জান্নাতের সব বাসিন্দাই হবে শশ্রুবিহীন যুবক।” এ হাদীছ যথার্থ।

অন্যদিকে নবীজি (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম)- এঁর নাতি হাসান-হুসাইন জান্নাতী যুবকদের সর্দার হওয়ার অর্থ কেবল হতে পারে যে, সকল মুসলমান যুবক (চল্লিশ বছরের কম) অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের সর্দার হবেন হযরত হাসান (র.) ও হযরত হুসাইন (র.)।
আর হযরত আবু বকর (র.), হযরত উমর (র.), হযরত উসমান (র.) ও হযরত আলী (র.)সহ অনেক ছাহাবী হযরত হাসান (র.) ও হযরত হুসাইন (র.) এঁর শ্রদ্ধাভাজন রয়েছেন।

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম)-এঁর একাধিক হাদীছ দ্বারা হযরত হাসান (র.) ও হযরত হুসাইন (র.)- এঁর জান্নাতী যুবকদের সর্দার হওয়া সম্পর্কিত হাদীছের সাথে সাথে তাঁদের চেয়ে বয়স্ক তথা শ্রদ্ধাভাজন সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কেও জানা যায়।
যেমন :

عن أنس رضي اللَّه عَنْهُ ، عن النبي صلَّى اللهُ علَيهِ وسلَّم قال : « أرحمُ أمتى بأمتى أبو بكرٍ وأشدُّهم فى أمرِ الله عمرُ وأصدقُهم حياءً عثمانُ وأقرؤُهم لكتابِ اللهِ أبىُّ بنُ كعبٍ وأفرضُهم زيدُ بنُ ثابتٍ وأعلمُهم بالحلالِ والحرامِ معاذُ بنُ جبلٍ ولكلِّ أمةٍ أمينٌ وأمينُ هذه الأمةِ أبو عبيدةَ بنُ الجراح » أخرجه الترمذى (5/665 ، رقم 3791) وقال : حسن صحيح . والنسائى فى الكبرى (5/67 ، رقم 8242) ، وابن ماجه (1/55 ، رقم 154) ، وابن حبان (16/85 ، رقم 7137) ، والحاكم (3/477 ، رقم 5784) ، وقال : صحيح على شرط الشيخين . والطيالسى (ص 281 ، رقم 2096) ، وأحمد (3/281 ، رقم 14022) ، وأبو نعيم فى الحلية (3/122) ، والبيهقى فى الكبرى (6/210 ، رقم 11966) ، والضياء (6/225 ، رقم 2240) .

অর্থাৎঃ হযরত আনাস রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে আমার উম্মতের প্রতি সর্বাধিক দয়াপ্রবণ ব্যক্তি হল হযরত আবু বকর (রাঃ), আল্লাহর আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর ব্যক্তি হল উমর, সর্ববিষয়ে সবচেয়ে বেশী লজ্জাশীল ব্যক্তি হল উছমান, কোরআন শরীফের সবচেয়ে বড় হাফিয হল উবাই বিন কা’ব, শরয়ী বণ্টন নীতির সর্বাধিক জ্ঞানী হল যাইদ বিন ছাবিত, হালাল-হারামের সবচেয়ে জ্ঞানী হল মুআয বিন জবল। আর প্রত্যেক উম্মতের মাঝে একজন বিশিষ্ট আমানতদার ব্যক্তি থাকেন। আমার উম্মতের মাঝে এ ব্যক্তি হল হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জররাহ্।”
সুনানুত তিরমিযী ও সুনানু ইবনু মাজাসহ দশটি হাদীছগ্রন্থ
عن قتادة أن أنس بن مالك رضى الله تعالى عنه حدثهم أن النبي صلى الله عليه وسلم صعد أحدا وأبو بكر وعمر وعثمان فرجف بهم فقال : « اثْبُتْ أُحُد فإنما عليك نبى وصديق وشهيدان » أخرجه البخارى (3/1344 ، رقم 3472) ، وأبو داود (4/212 رقم 4651) ، والترمذى (5/624 ، رقم 3697) وقال : حسن صحيح . وأبو يعلى (5/466 رقم 3196) وابن حبان (15/280 رقم 6865) . وأخرجه أحمد (5/331 ، رقم 22862) ، وعبد بن حميد (ص 166 ، رقم 449) ، وأبو يعلى (13/509 ، رقم 7518) ، قال الهيثمى (9/55) : رجاله رجال الصحيح . وابن حبان (14/415 ، رقم 6492) ، والطبرانى (1/91 ، رقم 146) ، والضياء (1/466 ، رقم 340) عن سهل بن سعد رضى الله عنه .

অর্থাৎঃ হযরত আবু কাতাদা বলেন, আমাদেরকে আনাস বিন মালিক রদিয়াল্লাহু আনহু জানিয়েছেন যে, একসময় রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ পাহাড়ে আরোহন করলেন। তখন তাঁর সাথে হযরত আবু বকর, হযরত উমর ও হযরত উছমানও ছিলেন। এসময় হঠাৎ উহুদ পাহাড় কেঁপে উঠল। তখন নবীজি (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “হে উহুদ ! তুম স্থির হও। কারণ, তোমার উপর অবস্থান করছে একজন নবী, একজন ছিদ্দীক ও দুইজন শহীদ।” ছহীহুল বুখারী, সুনানুত তিরমিযী ও সনানু আবু দাউদসহ নয়টি হাদীছগ্রন্থ
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَانِ بْنِ عَوْفٍ وَسَعِيدُ بْنُ زَيْدٍ رضي اللَّه عَنْهُم ، أنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّىْ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : « أبُو بَكْرٍ فِي الْجَنَّةِ ، وَعُمَرُ فِي الْجَنَّةِ ، وَعُثْمَانُ فِي الْجَنَّةِ ، وَعَلِيٌّ فِي الْجَنَّةِ ، وَطَلْحَةُ في الْجَنَّةِ ، وَالزُّبَيْرُ في الْجَنَّةِ ، وعَبْدُ الرَّحْمَانِ بْنُ عَوْفٍ في الْجَنَةِ ، وَسَعْدُ بْنُ أبي وَقَّاصٍ فِي الْجَنَّةِ ، وَسَعِيدُ بْنُ زَيْدٍ بْنِ عَمْرٍ فِي الْجَنَّةِ ، وأبو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ فِيَ الْجَنَّةِ » حديث عبد الرحمن بن عوف : أخرجه الترمذى (5/647 ، رقم 3747) ، وأحمد (1/193، رقم 1675) ، وأبو نعيم فى المعرفة (1/20، رقم 54) ، وابن عساكر (21/78) . حديث سعيد بن زيد : أخرجه أحمد (1/187، رقم 1629) ، وابن أبى شيبة (6/350 ، رقم 31946) ، وابن أبى عاصم (2/619 ، رقم 1428) ، وأبو نعيم فى الحلية (1/95) ، والضياء (3/283 ، رقم 1084) .

অর্থাৎঃ হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ ও হযরত সাঈদ বিন যাইদ রদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আবু বকর জান্নাতে, উমর জান্নাতে, উছমান জান্নাতে, আলী জান্নাতে, তলহা জান্নাতে, যুবাইর বিন আউওয়াম জান্নাতে, আবদুর রহমান বিন আউফ জান্নাতে, সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাছ জান্নাতে, সাঈদ বিন যাইদ বিন আমর জান্নাতে, আবু উবাইদা ইবনুল জররাহ্ জান্নাতে।” সুনানুত তিরমিযী ও মুসনাদু আহমদসহ আটটি হাদীছগ্রন্থ।

উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে অনুসরনীয় ইমাম বা কোন ক্বওমের সর্দার হওয়ার উপযুক্ত হলেন তিনিই যিনি তাদের মধ্যকার সকলের মাঝে সর্বাধিক পরহেজগার।
আর এই পরহেজগারীতায় হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক শীর্ষজন।
তিনিই সর্বযুগে অনুসরনীয় ইমাম।
কবি বলেন,
শাহ্ অাস্ত হুসাইন; বাদশাহ্ হাস্ত হুসাইন।
___________
মারহাবা ইয়া হুসাইন! ইয়া হুসাইন মারহাবা!
মারহাবা শহীদানে কারবালা মারহাবা!
ইয়া শহীদানে কারবালা মারহাবা!!
_____________

Top