১৯- বিতির নামাযের যেই সকল মাসআলা নিয়ে আহনাফ ও আহলে হাদীসদের মাঝে বিরোধ রয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো
প্রথমে শিরোনাম আকারে তা উল্লেখ করা হলো :
১) সময় মতো বিতির পড়া না হলে পরে আদায় করা।
২) বিতিরের রাকাত সংখ্যা তিন।
৩) তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে দোয়ায়ে কুনূত  পড়া।
৪) দোয়ায়ে কুনুতের আগে তাকবীর দিয়ে হাত উঠানো এবং পূনরায় হাত বাঁধা।
৫) দুই রাকাত করে প্রথম বৈঠক করা এবং এই বৈঠকে সালাম না ফেরানো।

❇ এবার বিস্তারিত আলোচনা ❇
১) বিতির ছুটে গেলে কাযা করতে হবে
▆ আহলে হাদীসদের মতে :
বিতির নামায এমনকি ফরয  নামায নামাযও যদি ছুটে যায় তাহলে কাযা করতে হবে না। বরং তাওবা করলেই চলবে।
قوله تعالي: إن الصلاة كانت علي المؤمنين كتابا موقوتا (سورة النساء-١٠٣)
��আহনাফের মতে :
তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্ত ব্যক্তির জন্য তাহাজ্জুদের পর বিতির পড়া উত্তম। অন্যরা ইশার নামাযের সঙ্গেই বিতির পড়বে।
কেউ যদি সময় মতো বিতির পড়তে না পারে তাহলে পরে কাযা করতে হবে।
দলীলঃ ��
عن أبي سعيد، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من نام عن وتره، أو نسيه، فليصله إذا ذكره (أبو داود- ١/٢٠٣، سنن البيهقي- ٢/٤٨٠، المؤطأ لمالك- ٤٤، إبن ماجة- ١/٤٣٣)

��আহলে হাদীসদের দলীলের জবাব :
তাদের উত্থাপিত আয়াতে নামাযের সময় নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি যেমন উল্লেখ হয়েছে তেমনি পরোক্ষভাবে কাযা করার বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে। সহীহ হাদীসে ও আছারে সাহাবাতে বিষয়টির ব্যাখ্যা বিদ্যমান।
তাওবা ই যথেষ্ট এই কথাটি ঠিক নয়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, তা এমন তাওবা হতে হবে যার মধ্যে কাযা হয়ে যাওয়া নামায সমূহ আদায় করাটা অন্তর্ভূক্ত।
সুতরাং শুধু তাওবার মাধ্যমেই কাযা নামায মাফ হয়ে যাবে এই কথাটি ঠিক নয়।
কারণ প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  স্বয়ং খন্দকের যুদ্ধে কাযা হয়ে যাওয়া নামায পরবর্তীতে আদায় করেছেন। এবং হাদীসে কাযা নামায আদায় করার নির্দেশ এসেছে।

২) বিতির সর্বনিম্ন তিন রাকাত
▆ আহলে হাদীসদের মতে :
বিতিরের নামাজ এক রাকাত।
দলীলঃ ��
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم صلاة الليل مثني مثني والوتر ركعة قبل الصبح (إبن ماجة- ٨٢)
عن عائشة قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يسلم في كل ثنتين و يوتر بواحد (إبن ماجة- ٨٢)
��আহনাফের মতে :
বিতিরের রাকাতের সংখ্যা তিনের অধিকও নয় আবার কম ও নয়।
দলীলঃ ��
عن أبي سلمة بن عبد الرحمن، أنه سأل عائشة رضي الله عنها، كيف كانت صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم في رمضان؟ فقالت: ما كان يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعا، فلا تسل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا، فلا تسل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي ثلاثا (رواه البخاري- ١/١٥٤، مسلم- ١/٢٥٤، الترمذي- ١/١٠٦، النسائي- ١/١٩٢، إعلاء السنن- ٦/٢٣، المؤطأ لمحمد- ١٤٥، شرح معاني الآثار- ١/١٩٦، المستدرك للحاكم- ١/٣٠٥)

��আহলে হাদীসদের দলীলের জবাব :
তাদের উল্লেখিত হাদীস আহনাফের বিপক্ষে নয় বরং পক্ষে। কারণ তারা হাদীসের মর্ম বুঝতে ভুল করেছে। আর হাদীসের মর্ম হলো, প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  তাহাজ্জুদের নামায দুই দুই রাকাত করে আদায় করতেন। আর সুবহে সাদিক হওয়ার পূর্বে শেষ দুই রাকাতের সাথে এক রাকাত মিলিয়ে মোট তিন রাকাত বেজোড় করে আদায় করতেন। এটা হলো হাদীসের আসল মর্ম।

৩) তৃতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুর পূর্বে দোয়ায়ে কুনূত পাঠ করা
▆ আহলে হাদীসদের মতে :
রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কুনূত  পাঠ করবে।
দলীলঃ ��
عن أنس رض قال قنت رسول الله صلي الله عليه وسلم بعد الركوع (إبن ماجة- ٨٣)
��আহনাফের মতে :
তৃতীয় রাকাতের কেরাতের পরে রুকুর পুর্বে কুনূত  পড়া হবে।
দলীলঃ ��
হযরত আসিম রহ. বলেন,
حدثنا عاصم، قال: سألت أنس بن مالك عن القنوت، فقال: قد كان القنوت قلت: قبل الركوع أو بعده؟ قال: قبله، قال: فإن فلانا أخبرني عنك أنك قلت بعد الركوع، فقال: كذب إنما قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا (رواه البخاري- ١/١٣٦)------------- إبن ماجة- ٨٣، مصنف إبن أبي شيبة- ٤/٥٢١، مشكل الآثار- ١١/٣٧٤، فتح الباري- ٢/٥٦٩

��আহলে হাদীসের দলীলের জবাব :
১) তারা আনাস রাযি. এর হাদীস দলীল হিসাবে এনেছে।
অথচ আনাস রাযি. বলেছেন, যে বলবে আমি রুকুর পরে কুনূত  পড়ার কথা বলেছি সে মিথ্যা বলেছে।
২) অথবা রুকুর পর কুনূত পড়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুনুতে নাযেলা।
আর আহনাফের মতেও কুনুতে নাযেলা রুকুর পর পড়া হয়।
সুতরাং কোন মতানৈক্য বাকী রইলো না।

৪) দোয়ায়ে কুনুতের আগে তাকবীর দিয়ে হাত উঠানো এবং পূনরায় হাত বাঁধা। এরপর কুনূত পাঠ করা
▆ আহলে হাদীসদের মতে :
কুনুতের পূর্বে তাকবীর বলে হাত বেঁধে এরপর কুনূত পড়ার নিয়ম হাদীসে নেই।
বরং দুই হাত মুনাজাতের মতো উঠিয়ে কুনূত পাঠ করবে।
দলীলঃ ��
عن أنس بن مالك، أن نبي الله صلى الله عليه وسلم كان لا يرفع يديه في شيء من دعائه إلا عند الاستسقاء، فإنه كان يرفع يديه حتى يرى بياض إبطيه  (إبن ماجة، رقم الحديث - ١١٨٠)
��আহনাফের মতে :
বিতিরের তৃতীয় রাকাতে কেরাতের পরে তাকবীর বলে হাত বেঁধে তারপর কুনূত পড়তে হবে।
দলীলঃ ��
عن عبد الله، أنه كان يرفع يديه إذا قنت في الوتر(مصنف إبن أبي شيبة- ٢/٣٠٧)
وعن علي، أنه كبر في القنوت حين فرغ من القراءة وحين ركع. وفي رواية: كان يفتتح القنوت بتكبيرة وكان عبد الله بن مسعود يكبر في الوتر إذا فرغ من قراءته حين يقنت، وإذا فرغ من القنوت وقال زهير، قلت لأبي إسحاق، أتكبر أنت في القنوت في الفجر؟ قال: نعم وعن البراء: أنه كان إذا فرغ من السورة كبر ثم قنت وعن إبراهيم، يقوم في القنوت في الوتر، إذا فرغ من القراءة، ثم قنت ثم كبر وركع وعن سفيان، كانوا يستحبون إذا فرغ من القراءة في الركعة الثالثة من الوتر أن يكبر، ثم يقنت (قيام الليل- ص٢٢٩،٢٣٠)
وأما التكبيرة في القنوت في الوتر , فإنها تكبيرة زائدة في تلك الصلاة , وقد أجمع الذين يقنتون قبل الركوع على الرفع معها (شرح معاني الآثار- ١/٤١٦)

��আহলে হাদীসদের দলীলের জবাব :
বিতিরের নামাযে দোয়ায়ে কুনূত পাঠের সময় হাত উঠিয়ে তাকবীর বলার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।
আর লা মাযহাবীরা কুনুতের সময় হাত না উঠানোর ব্যাপারে একটা হাদীসও দেখাতে পারবে না।
তারা যে হাদীসটি দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন তাতে নামাযের বাহিরে দোয়ার সময় যে পরিমান হাত প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  উঠাতেন তার চেয়ে ইস্তিসকার নামাযের সময় হাত বেশি উঠাতেন। এই বিষয়টি হাদীসে বুঝানো হয়েছে।
সুতরাং এই হাদীসটি বিতিরের নামাযে কুনূত পাঠের সময় হাত উঠিয়ে তাকবীর বলার বিষয়টিকে নফি করে না।
কারণ এখানে তাকবীরের জন্য হাত তোলাটা দোয়ার জন্য হাত তোলার মতো নয়।
তাই লা মাযহাবীদের কিয়াস অসার (void) বলে প্রমাণিত হলো।
তারা বলে থাকে কুনুতের সময় মুনাজাতের মতো হাত তুলে রাখবে। এটি তাদের বানানো একটি বিষয়।
হাদীসে যার কোন অস্তিত্ব নেই। তারা বিতিরের দোয়ায়ে কুনূত কে ইস্তিসকার দোয়া ও সাধারন দোয়ার সাথে তুলনা করে হাত তুলে রাখার কথা বলে থাকে। এটিও তাদের একটি অবান্তর যুক্তি।  

৫) বিতির নামাযে দুই রাকাত পড়ে প্রথম বৈঠক করা এবং এ বৈঠকে সালাম না ফেরানো
▆ আহলে হাদীসদের মতে :
বিতির তিন রাকাত দুই সালামে আদায় করা হবে।
অর্থাৎ প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরাতেন পরে দাঁড়িয়ে এক রাকাত আদায় করতেন। এবং দ্বিতীয় রাকাতে মাগরিব নামাযের মতো বৈঠক করতেন না।
দলীলঃ ��
عن عائشة قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يسلم في كل ثنتين و يوتر بواحد (إبن ماجة- ٨٢)
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্নিত তিনি বলেন, রাসূল সা. (তাহাজ্জুদের) প্রতি দু’ রাকাত পরপর সালাম ফিরাতেন। এবং এক রাকাত বিতির আদায় করতেন। (ইবনে মাজাহ ১/৪২৯-৪৩৪)
��আহনাফের মতে :
বিতিরের দুই রাকাতের পর যথারীতি প্রথম বৈঠক হবে এবং তাশাহহুদের পর তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াতে হবে। তৃতীয় রাকাত সমাপ্ত হওয়ার পর সালাম ফেরাতে হবে।
দলীলঃ ��
عن عائشة، قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يسلم إلا في آخرهن وهذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه وعنه أخذه أهل المدينة  (المستدرك علي الصحيحين للحاكم- ١/٣٠٤)
عن سعد بن هشام، أن عائشة حدثته، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان لا يسلم في ركعتي الوتر( النسائي- ١/١٩١)------------ فتح الباري-٢/٤٨١، جامع المسانيد- ١/٤٠٢، زاد المعاد- ١/٣١٩، المعجم الأوسط، رقم الحديث-٦٦٦١، المؤطأ لمالك، رقم الحديث- ٢٦٦)

��আহলে হাদীসদের দলীলের জবাব :
প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  হযরত ওমর এবং তাবেয়ীগনের মধ্য থেকে অনেকের আমল হলো, বিতির এক সালামের মাধ্যমে তিন রাকাত আদায় করা । এবং অনেক হাদীসে বিতির নামাযকে মাগরিবের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
সুতরাং মাগরিবের নামাযে যেমনিভাবে দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ শেষ করে সালাম ফিরানো ব্যতীতই তৃতীয় রাকাতের জন্য উঠে যায় এমনিভাবে বিতির নামাযেও দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ পড়ে উঠে যাবে। এবং তৃতীয় রাকাতের শেষে সালাম ফিরাবে।
আর লা মাযহাবীরা এখানেও হাদীসের মর্ম বুঝতে ভুল করেছে।
তা হলো প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  ১১ অথবা ১৩ রাকাত নামায আদায় করতেন।
এর মধ্যে আট রাকাত অথবা ১০ রাকাত হলো তাহাজ্জুদ।
আর বাকী তিন রাকাত হলো বিতির।
আর প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  প্রত্যেক দুই রাকাতের পর সালাম ফিরাতেন।
কিন্তু শেষ দুই রাকাতে গিয়ে তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরানো ব্যতীত উঠে যেতেন। এবং সাথে এক রাকাত মিলিয়ে মোট তিন রাকাত বিতির আদায় করতেন।
আর লা মাযহাবীরা যে ভুল বুঝে থাকে তা হলো যে, প্রিয় নাবী রাসূলুন কারীম (صلى الله عليه و آله و سلم)  সর্বশেষ দুই রাকাতে সালাম ফিরাতেন এবং দাঁড়িয়ে এক রাকাত বিতির আদায় করে নিতেন। দুই সালামে মোট তিন রাকাত পড়ে নিতেন। তাদের এই ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন ও অগ্রহনযোগ্য।

Top