হাদীস শাস্ত্রে মুরসাল হাদীসের ব্যাপারে যে হুকুম আছে তা জানুন। নামধারী সালাফী ওহাবীদের প্রত্যাখ্যান করুন।
আগে বলে নেই মুরসাল হাদীস কি?
মুরসাল হাদীস হল ঐ সকল হাদীস যার সনদে সূত্র বিচ্ছিন্নতা আছে। যেমন তাবেয়ি সরাসরি রসূলের বরাত দিয়ে হাদীস বর্ণনা করলে এ সনদের মান মুরসাল হবে। যেহেতু তাবেয়ি যে সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তা বর্ণনা করেননি।
হানাফী মাযহাবের ইমামগন যে সকল ক্ষেত্রে মুরসাল হাদীসকে দলিল হিসেবে পেশ করেন তার কয়েকটি হল
(১) যদি মুরসাল হাদীস কোন সহিহ হাদীসের পক্ষে থাকে।
(২) যদি মুরসাল হাদীসের পক্ষে সাহাবীদের আছার থাকে এবং বিপক্ষে সহীহ সনদে হাদীস না থাকে।
(৩) আমলে মুতাওয়ারাছার (যে আমল ধারাবাহিক ভাবে উম্মতের মধ্যে চলে আসছে।) পক্ষে।
(৪) মুরসাল হাদীসের বিপক্ষে কোন সহিহ হাদীস নেই, সাহাবীদের আছার নেই সে ক্ষেত্রে কিয়াস না করে মুসরাল হাদীস থেকে মাসয়ালা দেওয়া হয়। বিশেষ করে রাবি যদি তাবেয়ী পর্যায়ের হয় বা বিশ্বস্থ হয়।
(৫) একই বিষয়ে যদি একাধীক মুরসাল হাদীস পাওয়া যায় এবং বিপরীতে সহীহ হাদীস না থাকলে।
এরকম নীতি আরো আছে। এগুলো মুরসাল হাদীসের ব্যাপারে হানাফী মাসলাকের ইজতিহাদগত নীতি বা উসূল।
তারাবির নামায ২০ রাকাত কিনা, সালাতের মধ্যে হেসে দিলে ওজু থাকবে কি না ... ইত্যাদি ব্যাপারে এ সকল উসুলের উপর ভিত্তি করা হয়।
এখন আমরা দেখবো মুরসাল হাদীসের ব্যাপারে আমাদের সালাফরা তথা সালফে সালেহীনরা কি বলেন-
ইমাম মালিক (রহঃ) এবং মালিকি মাযহাবের সকল প্রসিদ্ধ ফকীহগণের মত হল, নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির মুরসাল হাদীস শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং এর উপর আমল করা যাবে, যেমন মুসনাদ হাদীসের মত।
[সূত্রঃ তাজরীদ আল তামহীদ লিমা ফি আল মুয়াত্তা মিনাল আসানিদ, ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল বার, কায়রো,১৩৫০, ১/২]।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ইমাম মালিক (রহঃ) এর মতই মুরসাল হাদীসকে সহীহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, চাই এর সমর্থনে অন্য কোন সহীহ হাদীস থাকুক বা না থাকুক।
[সূত্রঃ তাদরীবুর রাবী, ইমাম সুয়ুতী - ১/৩০৪]।
ইমাম শাফী (রহঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তাঁর কিতাব 'আল রিসালাহ' তে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং কিছু শর্ত দিয়েছেন।
সেগুলো হলঃ
ক) এর সমর্থনে অন্য সনদে মুসনাদ হাদীস থাকতে হবে অথবা মুরসাল হাদীসের বক্তব্যের সাথে অধিকাংশ স্কলারদের মতের মিল থাকতে হবে।
খ) আর যে রাবী মুরসাল হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাকে উত্তম তাবেঈ হতে হবে।
সূত্রঃ আল রিসালাহ, ইমাম শাফী, আহমদ শাকির এর সম্পাদনা, কায়রো, ১৩৫৮/১৯৪০, পৃঃ ৪৬১-৪৬২।
বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ
আল রিসালাহ, ইমাম শাফী, আহমদ শাকির এর সম্পাদনা, কায়রো, ১৩৫৮/১৯৪০, পৃঃ ৪৬১-৪৭০; ইংরেজী অনুবাদ, মাজিদ খাদ্দুরি, ২য় সম্পাদনা, দ্যা ইসলামিক টেক্সটসঃ সোসাইটি, পৃঃ ২৭৯-২৮৪।
এসব শর্তের আলোকে ইমাম শাফী নিজেই সাঈদ বিন আল মুসায়য়াবের ইরসাল গ্রহণ করেছেন, যিনি একজন উঁচু মাপের তাবেয়ী ছিলেন। এই তাবেয়ী এর একটি মুরসাল হাদীস আলোচনা করে তিনি বলেন, 'এটি আমাদের মতামত, কারণ ইবনে আল মুসায়য়াবের ইরসালটি উত্তম।'
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণ করেছেন যদি তার বিপরীতে কোন কিছুই পাওয়া না যায় এবং তিনি কিয়াসের চেয়ে মুরসাল হাদীসকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
[সূত্রঃ ইলাম আল মুয়াক্কিন, ইবনুল কাইয়্যিম, দ্বিতীয় সংস্করণ, দারুল ইবনুল জাওযী, বৈরুত, ১৩৯৭ হিঃ/১৯৭৭ খ্রিঃ, ২/৫৫]।
আল্লামা ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ
“মুরসাল হাদীছকে ইমাম মালেক (রহঃ) ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহীহ –এর শ্রেণীভুক্ত করেছেন। ”
[সূত্রঃ তাকরীবু লিন নববীঃ খ-১, পৃ-১৯৮]।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে ইরসাল করা হলে সেই মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।
[সূত্রঃ মিনহাজ আল সুন্নাহআন নববীয়াহ ফী নকদকালাম আল শিয়া ওয়াল ক্বাদারিয়াহ, ইবনে তাইমিয়্যা, মাকতাবাহ আল আমিরীয়াহ, বুলাক, ১৩২২, ৪:১১৭]।
ইবনে তাইমিয়াহ্ আরও লিখেনঃ যে মুরসালের অনুকূলে অন্য কিছু থাকে অথবা পূর্ববর্তীগণ এ অনুযায়ী আমল করে এমন মুরসাল ফক্বীহগণের সর্ব সম্মতিক্রমে দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
[সূত্রঃ ইকামাতুদ দলীল আলাবুতলানিত তাহলীল )
আরো দেখুনঃ তাঁরই কিতাব মাজমূউল ফাতওয়াঃ ২৩/২৭১।
আরো দেখুনঃ মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাঃ ৪/১১৭, আল ফাতাওয়াল কুবরাঃ ৪/১৭৯]।
আবু দাউদ (রহঃ) এর মতেও মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য, শর্ত হল, ঐ বিষয়ে কোন মুসনাদ হাদীস পাওয়া যাবে না, আর যদি পাওয়া যায় তাহলে তা মুরসাল হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।
[সূত্রঃ সুরুত আল আইম্মাহআল খামসাহ, আল হাজিমি, আল কাউসারী সংস্করণ, কায়রো, পৃ - ৪৫]।
খতীব আল বাগদাদী(রহঃ)ও মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন যদি তা উত্তম তাবেঈ থেকে বর্ণিত হয় অথবা তার সমর্থনে মুসনাদ হাদীস পাওয়া যায়।
[সূত্রঃ আল কিফায়া ফি ইলমআল রিওয়ায়াহ, খতীব বাগদাদী, হায়দারাবাদ, ১৩৫৭, পৃ - ৩৮৭]।
উম্মতের বিশাল অংশ মুরসাল হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন।
[সূত্রঃ আত-তামহীদঃ ১/৪, আরও দেখুনঃ আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালীঃ ১৯৫]।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেনঃ ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মালিকের মতে মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য এবং দলীল হিসেবে দেখানো যাবে। ইমাম শাফি (রহঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণ করেন যদি তার সমর্থনে অন্য হাদীস থাকে।
[সূত্রঃ নুকবাতুল ফিকর; শরহু নুকবাতিল ফিকার, বাংলা অনুবাদ, ইসলামিয়া কুতুবখানা, ঢাকা, পৃষ্ঠা - ১৫৭
মুরসাল হাদীস সম্পর্কে জানতে আরও দেখতে পারেনঃ
আল আহকাম ফি উসূলিল আহকামঃ খ-২, পৃ-১৭৭; উসূলে ছরাখসী-১/৩৭০; মুকাদ্দামায়ে ফতহুল মুলহিম-৭৯, ৮০।
___________________
আল্লামা আলা আল-বোখারি রহ. উসুলুল বাযদাবি এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন,
وَ فيْهِ اَيْ فِيْ رد المرسل- تعطيل كثير من السنن ، فإن المراسيل جمعت فبلغت قريبا من خمسين جزءا
অর্থাৎ মুরসাল হাদিস প্রত্যাখ্যান করলে অনেক সুন্নাহ বাতিল করা আবশ্যক হবে। কেননা মুরসাল হাদিস যদি একত্র করা হয়, তবে তা পঞ্চাশটি বৃহৎ বইয়ের রূপ নিবে।
আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারি রহ. বলেন,
مَنْ ضَعَّفَ الحَدِيثَ بِا لإرْسَالِ نَبَذَ شَطْرَ السُّنَّةِ المَعْمُولِ بِهَا
অর্থাৎ মুরসাল হাদিসকে যয়িফ সাব্যস্ত করলে প্রচলিত এমন অনেক সুন্নাহ পরিত্যাগ করা হবে যেগুলোর উপর আমল করা হয়ে থাকে।
ইমাম শাফেয়ি রহ. এর চারটি শক্তিদায়ক বিষয়ের আলোকে অনেক মুরসাল হাদিস সহিহ ও দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হয়েছে। এগুলো পৃথক করলে মুরসাল হাদিসের সংখ্যা বেশ কমে যাবে।