❏ প্রশ্ন : অনেকে বলে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকালের পর যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যাওয়া, চাই কোনো মাহফিলে হোক, কিংবা কোনো দোকানে হোক, অথবা তার কোনো খাটি আশেককে দীদারের দ্বারা ভূষিত করতে ইচ্ছুক, চাই সে প্রথিবীর পূর্ব প্রান্তে হোক বা পশ্চিম প্রান্তে হোক, এমন কখনোই পারে না। মৃত্যুর আগে ও পরে উভয়ের হুকুম কি এক? 


কিছু বেআদব তো এমনও বলে যা অশোভনীয় শব্দ ও ভঙ্গি যে, মাজলিসে রাসূল (ﷺ) কোথায় আছে? চেয়ার, চৌকি, নীচে উপরে এদিক সেদিক তালাশ করে। (নাউযুবিল্লাহ) এমন ঠাট্টা বিদ্রুপ রাসূল (ﷺ) এর শানে করাটা কেমন? কোনো আহলে ঈমান মুসমান আলেম বলেত পারে? গোমরাহরা ছাড়া কেউ কখনো বলতে পারে না। এমন মানুষের শেষ পরিণাম খারাপ হওয়ার খুবই আশঙ্কা?


✍ জবাব : وبه نستعين حامدا ومصليا ومسلما বন্ধুরা শোনো, রাসূল (ﷺ) এর দুনিয়াবী জীবন অহী ও তাবলীগের সময় ছিলো। যা সৃষ্টির জগতের সাথে সম্পৃক্ত। যা স্থান ও কালের সাথে, প্রয়োজন ও শরীরের সাথে সম্পৃক্ত। মৃত্যুর পরে আল্লাহর সামনে হাজেরীর সময়। যা আল্লাহর দীদারের মধ্যে ডুবে আছে। যার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা নেই। যা নির্দেশ জগতের সাথে সম্পৃক্ত। যার মধ্যে সময়, স্থান ও দিক ইত্যাদি কোনো জিনিসের বন্ধন নেই। তিন যুগের সাথে সম্পর্ক রাখে না। বরং এখন নুরানী সুক্ষ্ম শরীরের সাথে সম্পৃক্ত। যা ঘনত্ব থেকে পবিত্র। যখন সেখানে মানবিক চিন্তা ধারণার দখল নেই, মানুষের বিবেক বুদ্ধিও সেখানে আল্লাহর শক্তিদান ছাড়া সেখানে পৌছতে পারে না। বরং তার মধ্যে আপত্তি করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। মুমিন মুসলিম হওয়ার জন্য অদৃশ্যের উপর ঈমান প্রথম শর্ত। অতএব সুক্ষ্ম জগতের দৃষ্টান্ত ঘনত্বপূর্ণ জগতে তালাশ করা এবং সৃষ্টির জগতকে নির্দেশের জগতের উপর কিয়াস করা বোকামী ও মূর্খতা। রাসূল (ﷺ) বরং সকল নবীগণ মৃত্যুর পরে নির্দেশের জগতের সাথে সম্পর্ক রাখে। যা অনেক হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত। এক মুহূর্তে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করা প্রমান্য বিষয়। যেমন, ফেরেশতারা নির্দেশের জগতে সম্পর্ক তারা এক মুহূর্তে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারে। এমনি সকল নবীগণ ভ্রমণ করা নিশ্চিত বিষয় । وللأخرة خير لك من الأولى (আপনার জন্য দুনিয়া থেকে আখেরাত উত্তম)এই আয়াত থেকেও কিছুটা ইঙ্গিত মিলে।


পরিপূর্ণ বুযুর্গদের ঘটনাবলী দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত। বোখারী ও মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত আছে। রাসূল (ﷺ) বলেন, من رأني في المنام فسيراني في اليقظة ولا يتمثل الشيطان بي  ‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে, সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে। শয়তান আমার সাদৃশ্য অবলম্বন করতে পারে না।’


ওলামায়ে কেরামের মাঝে এই হাদীসের মধ্যে মতানক্য আছে। কেউ বলে, কেয়ামতের দিন দেখবে। এই ব্যাখ্যার উপর আপত্তি রয়েছে। কারণ সকল মুমিনই কেয়ামতের দিন রাসূল (ﷺ) এর দীদার লাভ করবে। এরপর فسيراني في اليقظة (অতি সত্ত্বর আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে।) এর উদ্দেশ্য কী?


কেউ কেউ বলে, এই হাদীস নববী যুগের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ যে নববী যুগে না দেখে ঈমান এনেছে এবং রাসূল (ﷺ)কে স্বপ্নে দেখেছে, সে সোহবাতের দৌলত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যেও আপত্তি রয়েছে। কারণ হাদীসের শব্দ নববী যুগ বুঝাতে হবে। অথচ নববী যুগ খাস করা ঠিক নয়। রাসূলের ইন্তেকালের পর তার দীদার অসম্ভব মনে করার কোনো কারণ নেই।


আর অনেকে বলে, এই বিধান তার জন্য বিশেষভাবে, যে রাসূল (ﷺ)কে দেখার যোগ্যতা রাখে। তারা হলেন, অলিগণ। এই বিশেষত্বেও হাদীসের উদ্দেশ্যের বিপরীত।


সবচেয়ে উত্তম ও উপযুক্ত ব্যাখ্যা হলো, এই হাদীসটি তার ব্যাপকতার উপর স্থির রাখবে। তখন উদ্দেশ্য হবে, যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)কে স্বপ্নে দেখবে, সে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখবে। সর্ব সাধারণ মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর শয্যায় দেখবে। যতক্ষণ পর্যন্ত জগত সাজানো সৌন্দর্য দ্বারা ভূষিত না হবে, রূহ শরীর থেকে বের হবে না। এটা রাসূল (ﷺ) এর ওয়াদা পূর্ণ হওয়ার জন্য। আর বিশেষ ব্যক্তিরা কম বেশি সারা জীবন সুন্তরের অনুসরণ অনুপাতে দেখবে। কিছু বিশ্লেষকরা বলেছে, হাদীসের চাহিদা হলো, জাগ্রত অবস্থায় দেখবে বাহ্যিক চোখ দিয়ে নয়। অলিগণ জাগ্রত অবস্থায় অন্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখেন। অনেক সময় অন্তর দৃষ্টি এতই প্রখর হয় যে, বাহ্যিক দৃষ্টি লুকিয়ে যায়। মনে হয় যেন, বাহ্যিক চোখ দিয়েই দেখছে। যে ব্যক্তি এই দৌলত অর্জন করতে পারছে, সে বড় ভাগ্যবান। যে এমন দৌলত থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে পোড়াকপাল। এই মাসআলা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা ঈমানের চাহিদা নয়। বরং ঈমানের বক্রতা। কারণ এমন দৌলত থেকে বঞ্চিত থাকলে ঠাট্টা নয়, বরং লজ্জিত ও আফসোস করা উচিত। এটা একটা নাজুক মাসআলা। যা ঈমানের মাপকাঠি নষ্ট করে ফেলে। এমন সুক্ষ্ম মাসআলা নিয়ে ঠাট্টা করা ঈমানের শান নয়। বুঝে না আসলে চুপ থাকা উচিত।


আল্লামা সুয়ূতী (رحمة الله) বর্ণনা করেন। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে স্বপ্নে দেখেন। এরপর জাগ্রত অবস্থায় হযরত মায়মুনা রাযি.র মাধ্যমে দেখেন।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অহী ও তাবলীগের যুগে মানবিক আকৃতিতে থাকাটা আবশ্যক ছিলো। মৃত্যুর পরে যখন অহী ও তাবলীগের যুগ শেষ হয়ে গেলো, তখন মানবিক আকৃতিও শেষ হয়ে গেছে। এখন যে, মানবিক আকৃতির সাথে আছেন, তা খুবই সুক্ষ্ম ও নুরানী। যা মানবিক প্রয়োজন থেকে একেবারে পবিত্র।


বনি আদমকে এজন্য মানুষ বলা হয়, বাহ্যিক চামড়ার কারণে তাকে প্রকাশ করা হয়।  سموا بذلك لبدو بشرتهم التي هي ظاهر الجلد(جوهرة)

‘তাদের এই নামকরণ করা হয়েছে তাদের চামড়ার কারণে, যা চামড়ার উপরিভাগ।’ (জাওহারাহ)


এভাবে সম্মানিত ফেরেশতা যারা সুক্ষ্ম জগতের সৃষ্টি। যাদের বৈশিষ্ট্য হলো, বিভিন্ন আকৃতিতে যেখানে চায় যখন চায় আল্লাহর নির্দেশে ভ্রমণ করে। মুসলিম বিন এমরান বিন হাসীন থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ফেরেশতা আমার কাছে সালাম দিতো এবং সাক্ষাৎ করতো।


এখন প্রশ্ন হলো, রাসূল (ﷺ) যিনি শরীর ও রূহ দ্বারা গঠিত, তাকে কি দেখা যেতে পারে? নাকি রূপক আকৃতি? এর জবাবে অধিকাংশ জ্ঞানীরা যেমন ইমাম গযালী (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে রূপক আকৃতিতে দেখে। এভাবে যারা আল্লাহ তা‘আলাকে স্বপ্নে দেখে তাও এমনি।


আবু বকর ইবনে আরবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে পরিচিত বৈশিষ্ট্যে দেখা সরাসরি দেখা। আর অপরিচিত বৈশিষ্ট্যে দেখা রূপক আকৃতিতে দেখা।


হাফেয সুয়ূতী (رحمة الله) এটাকে পছন্দনীয় বলেছেন। তিনি একথাও বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব শরীর আত্মাসহ দেখা অসম্ভব নয়। কারণ নবীগণ জীবিত। ইন্তেকালের পর তাদের পবিত্র রূহ তাদের মোবারক শরীর সমাহিত হওয়ার পর আবার তাদের শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নুরানী জগতে সুক্ষ্ম বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর তো يذهبون حيث يشاءون (তারা যেখানে যায় সেখানে যায়) এর পর্যায়ে চলে যায়। অর্থাৎ তাদের ইন্তেকালের পর তাদের সুক্ষ্ম শরীরে চলে যায়। শারিরিক এই স্থানান্তরের কারণে তাদের উপর মৃত্যু শব্দ ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষের বাহ্যিক চোখের সামনে পর্দা থাকার কারণও এটা। হাফেয আবু মানসুর বাগদাদী বলেন, ধর্মতত্ত্ববিদগণ বলেন, নবীগণ জীবিত, নিজ উম্মাতের নেক আমলের কথা শুনে খুশি হন। উম্মাতের দুরূদ শরীফ তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। নবীগণের মৃত্যু নেই। তবে মানুষের চোখের আড়ালে চলে যান। তারা ফেরেশতাদের মতো বিদ্যমান আছে। তাদেরকে দেখা যায় না। যেমন ফেরেশতাদেরকে দেখা যায় না। তবে বিদ্যমান আছে। তবে আল্লাহর দয়ায় যার নসীব হয়, তার কথা ভিন্ন। ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء ‘সেটা আল্লাহর দান, যাতে চান তাকে দেন।’


এই উক্তির পক্ষে আবু লায়লা বায়হাকী কর্তৃক উদ্ধৃত, হযরত আনাস রাযি. কর্তৃক বর্ণিত হাদীস সহায়ক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إن الأنبياء لا يتركون في قبورهم بعد أربعين ليلة ولكنهم يصلون بين يدي الله تعالى حتى تنفخ في الصور  ‘নবীগণকে চল্লিশ দিন পরে কবরে রাখা হয় না। তবে তারা আল্লাহর তা‘আলার সামনে কেয়ামত পর্যন্ত নামায আদায় করবে।’


এভাবে ইবনে হিব্বান তারীখের কিতাবে, তবরানী কাবীর কিতাবে, আবু নোআইম হিলিয়া কিতাবে, আবুল হাসান রা‘ওয়ানী কোনো কিতাবে বর্ণনা করেন। إن الله لا يترك نبيا في قبره أكثر من نصف يوم ‘আল্লাহ তা‘আলা কোনো নবীকে তার কবরে অর্ধ দিনের চেয়ে বেশি রাখেন না।’ এরপর তাফরীহুল আযকিয়ার প্রণেতা বলেন, মানসুর বাগদাদী বলেছেন, এই সকল হাদীস ও উক্তির সমষ্টি থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবিত। যখন চান কোথাও চলে যান। ভ্রমণ করেন। যা ইচ্ছা করেন।


আল্লামা সুয়ূতী (رحمة الله) অধিকাংশ অলীগণ থেকে রাসূল (ﷺ)কে দেখার কথা নকল করেন। অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাদের জাগ্রত অবস্থায় দেখার কথাও বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইয়াফিয়ী লিখেছেন, এক বার মিসরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। আবু আব্দুল্লাহ কোরাশী দো‘আ করতে চাইলেন। কিন্তু তাকে নিষেধ করা হলো। তখন তিনি সিরিয়ার দিকে চলে যান। হযরত ইবরাহীম আ.র সাথে সাক্ষাৎ হলো। তখন দুর্ভিক্ষ দূর হওয়ার দো‘আ চাইলেন। তিনি দো‘আ করলেন, দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে গেলো। ইমাম ইয়াফিয়ী (رحمة الله) আরো বলেন, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, আমি যোহরের আগে মুহাম্মাদ (ﷺ)কে দেখেছি। তিনি আমার মুখে থুথু দিয়েছেন। এরপর হযরত আলী রাযি.কে দেখেছি। তিনি ছয় বার আমার মুখে থুথু দেন। খলীফা ইবনে মুসা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি অধিকাংশ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে স্বপ্নে ও জাগ্রত অবস্থায় দেখতেন। এক রাতে তিনি সতের বার দেখেন। 


হযরত শায়েখ আবুল আব্বাস মুসা থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, এক মুহূর্তের জন্য যদি রাসূল (ﷺ)কে আমার সামনে থেকে অদৃশ্য দেখতাম, তাহলে নিজেকে মুসলমানদের অন্তর্ভ্ক্তু মনে করতাম না।


এই জাতীয় অনেক বর্ণনা ইমাম মাযুরী তাওসীকু আরিইয়িল ঈমান কিতাবে, আব্দুল্লাহ বিন আবি জামরা বাহজাতুন নুফুস কিতাবে, শায়খ সফি উদ্দিন আবু মানসুর তার কিতাবে বর্ণনা করেন। আবু আব্দুল্লাহ বলেন, এটা অস্বীকারকারী অলিদের কারামাতকে অস্বীকারকারী। অলিদের কারামাত অস্বীকারকারীদের সাথে কোনো কথা নেই। যে ব্যক্তি কারামাতে বিশ্বাসী তার উচিত, এটা বিশ্বাষ করা যে, كرامات الأولياء حق ‘অলিদের কারামাত সত্য।’


এই একটি সন্দেহ ও প্রশ্ন আছে যে, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা জান যায়, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন থেকে এমন দেখা প্রমাণিত নেই। এমনি অনেক বিষয় সাহাবা তাবেয়ী যারা হাদীস ও সুন্নাত সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী স্বর্ণ যুগের পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাদের যুগে পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও তা রাসূলের ভালোবাসার প্রমাণ বা নববী সুন্নাতের মোকাদ্দামা অথবা ভালো কাজ হোক। কেন নতুন আবিস্কার ও বিদআতের কারণে গোমরাহী ও না জায়েয হবে? যেমন মীলাদে মোস্তফা, কিয়ামে তা‘যীম, মীলাদ, ফাতেহা, মাসজিদের মধ্যে সাজ সজ্জা, বিছানা, মিনার ও মেহরব ইত্যাদি ইত্যাদি।


বন্ধুরা, বিদআত ও না জায়েয উচ্চরণ করা যতই সহজ, সেভাবে বাস্তব বিদআত যা আল্লাহ ও রাসূলের কাছে খারাপ তা প্রমাণ করা বড়ই কঠিন। যেখানে সেখানে না জায়েয ও বিদআত শব্দ ব্যবহার করা না আলেমের শান নয়। এটা একটা অনেক বড় সুক্ষ্ম মাসআলা। দীনি ইলমে পূর্ণ গভীরতা ছাড়া এই মাসআলার সমাধান দেওয়া অনেক কঠিন। যেই বিষয় কোরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চার দলিলের বিপরীত হবে তা বিদআত ও না জায়েয। সব জিনিস নয়। জাওহারা কিতাবে আছে, إن كل ما وافق الكتاب أو السنة أو الإجماع أو القياس فهو سنة ‘যে সব জিনিস কোরআন বা হাদীস বা ইজমা বা কিয়াসের সাথে মিল হবে তা সুন্নাত।’

সুতরাং নিজের মনের ইচ্ছা মতো শরয়ী কোনো বিষয়কে বিদআত ও না জায়েয বলা বড় দুঃসাহস ও বানোয়াট।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি আমাদের শরীয়াতের মধ্যে নতুন কিছু আবিস্কার করবে, কমিয়ে হোক কিংবা বাড়িয়ে হোক যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাদ দিয়ে দশ ওয়াক্ত বলা। বা দুই তিন ওয়াক্ত বলা। অথবা ত্রিশ রোযার জায়গায় বিশটা বা চল্লিশটি বলা। এমন নির্ধারিত শরয়ী বিষয়ে বেশি কম করা প্রত্যাখ্যাত ও বাতিল। দীনি কাজের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোনো উপায় উপকরণ নয়। নতুবা বর্তমান যুগের অধিকাংশ জিনিস বেদআত ও না জায়েয হয়ে যাবে। যেমন, মাসজিদ, মাদরাসা ও অধিকাংশ ইবাদাতের বিষয়ও বিদআত হয়ে যাবে। অথচ নতুন আবিস্কৃত বিষয়কে কেউ বেদআত বলেনি। في أمرنا এর মধ্যে শব্দটি ব্যাপক রাখা হয়েছে। দুনিয়া ও দীনি কোনো কিছুর কথা নেই। লেনদেন বা ইবাদাত কোনোটাই নির্দিষ্ট করা হয়নি।অতএব এর ব্যাপকতার উপর ভিত্তি করে দীনি, দুনিয়াবী, লেনদেন ও ইবাদাত সবই এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। দীনি বিষয় ও দুনিয়াবী বিষয় আলাদা করা এবং লেনদেনকে ইবাদাত থেকে আলাদা করা খ্রিস্টানদের ধর্ম। মুহাম্মাদী শরীআতে দীনি ও দুনিয়াবী উভয় বিষয়ের হুকুম সেটাই যেটা রাসূল (ﷺ) চালু করেছেন। মুসলমান একথা বলা যে, দুনিয়াবী বিষয়ে নতুন আবিস্কার জায়েয ও মোবাহ, দীনি বিষয়ে না জায়েয, অর্থাৎ নতুন আবিস্কারকে দীনি বিষয়ের সাথে বিশেষায়িত করা জায়েয নেই। বরং এটা খ্রিস্ট দর্শন। তারা গীর্যা ও রাজনীতি আলাদা করে ফেলেছে। আমাদের শরীয়াতে রাজনীতি, ইবাদাত ও রাষ্ট্র পরিচালনা সব কিছুই দীন। সুতরাং দীনি ও দুনিয়াবী বিষয়কে আলাদা করা আমাদের ধর্মে নেই। সুতরাং ফি আমরিনা বলতে দীনি দুনিয়াবী সকল বিষয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। মুসলমানদের মধ্যে যারা খ্রিস্টানদের সমমতের তারা এই পার্থক্য মানে। হাঁ, যারা দুনিয়ার স্বাদ, লেনদেন, দুনিয়ার উপকরণ ও দুনিয়া অর্জন সব কিছু ছেড়ে দিয়েছে তাদের বিষয়টি ভিন্ন। তারা দীনের গন্ডি থেকে বেরিয়ে বিলীনের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটা ভিন্ন বিষয়।


বিদআত ও সুন্নাতের আরো বিশ্লেষণ ও পরিচিতি এবং من أحدث في أمرنا..  এই হাদীসের পূর্ণ ব্যাখ্যা অধমের লেখা কিতাব তা‘রীফুল বিদআতে উল্লেখ আছে। সেখানে দেখে নিবে।


উল্লিখিত সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাব হলো, সাহাবা ও তাবেয়ীদের যুগ রাসূল (ﷺ) এর যুগের কাছে হওয়ার কারণে অলৌকিক ঘটনার প্রকাশ খুব কম ছিলো। সম্মানের বিভিন্ন উপায় উপকরণের প্রকাশ কম ছিলো। রাসূলের যুগের কাছে হওয়ার বরকতে সকলের অন্তরে মর্যাদা ও আগ্রহ বেশি ছিলো। নববী যুগ থেকে যখন মানুষ দূরে যেতে থাকে মানুষের অন্তর থেকে দীনের মর্যাদা, নবীর সম্মান ও ইবাদাতের আগ্রহ অনেক কমে যেতে থাকে। এ কারণে পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম দীনের প্রতি আগ্রহ, তাওহীদ, রেসালাত ও শরীয়াতের শান বুঝানোর জন্য বিভিন্ন উপকরণ নতুন নতুন আবিস্কার করেছেন। এই দৌলত ও নেআমত পরবর্তী ওলামা ও অলিদের ভাগ্যে লেখে দিয়েছেন। কে এটার অস্বীকার করতে পারে। যখন এর উপর প্রচুর সাক্ষ্য ও মুতাওয়াতির ঘটনা অস্বীকারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। وللأخرة خير لك من الأولى এই আয়াত এর সমর্থক।


ইমাম গযালী (رحمة الله) বলেন, অন্তর সম্পন্ন ব্যক্তিরা ফেরেশতা ও নবীগণের রূহ দেখেন। তাদের আওয়াজ শুনেন। ফায়েদা উপভোগ করেন। শায়খ জালালুদ্দীন সুয়ূতী (رحمة الله) সত্তর বারেরও বেশি এই দৌলত অর্জন করেছেন। শেষ কথা হলো, এই নেআমত অর্জনের পরিপূর্ণতা যদিও ঘুমের মধ্যে ছিলো, কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় দেখার পথে কোনো বাধা নেই। কারণ জাগ্রত অবস্থায় ফেরেশতাদেরকে দেখা সর্ব সম্মতক্রমে জায়েয এবং বাস্তব। এরপর নবীগণকে দেখার মধ্যে কোন বাধা রয়েছে? রাসূল (ﷺ)কে স্বপ্ন বা জাগ্রত অবস্থায় দেখা এক ও অভিন্ন বিষয়। যেমন জিবরাঈল আ.কে কখনো আসল আকৃতিতে, কখনো দাহিয়া কালবীল আকৃতিতে দেখা গিয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উভয় আকৃতিতে জিবরাঈলকেই দেখা যেত। এ কথার দ্বারা এই সন্দেহও দূর হয়ে গেলো, সারা পৃথবীতে হাজার হাজার মানুষ কিভাবে দেখে। কারণ এক সময়ে রাসূল (ﷺ) এর রূপক আকৃতি হাজার আয়নায় দেখিয়ে দেওয়া জায়েয ও সম্ভব।


কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেন, যে ব্যক্তি রাসূল্লাহ (ﷺ)কে এই আকৃতি ও গুণের সাথে দেখেছে, সে সত্যই দেখেছে। ইমাম নভভী (رحمة الله) বলেন, উভয় রকম দেখা বাস্তবতা। কারণ তার উপযুক্ত পদও এটাই।


রাসূল (ﷺ) দুনিয়াতে নবুয়াতের পদের দায়িত্বে ছিলেন। একারণে মানব পোশাকে আবৃত ছিলেন। এক দিকে নবুয়াতের পদের দায়িত্ব, অপর দিকে খোদাই বেলায়েতের মধ্যে লিপ্ত। যখন নবুয়াতের দায়িত্ব থেকে ফারেগ হয়েছেন, সর্বদার জন্য খোদাই বেলায়েতের মধ্যে লিপ্ত আছেন। মানব জামা খুলে ফেলা হয়েছে।


কাযী আবু বিন আওল বলেন, রাসূল (ﷺ)কে এই গুণে দেখা নবীর বাস্তবতা। নতুবা রূপক দেখা।


আমাদের আকীদা হলো, রাসূল (ﷺ) সশরীরে পবিত্র রওজায় অবস্থান করছেন। সকল প্রথিবী তার সামনে উপস্থিত। যা তিনি দেখছেন। তিনি যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যান। যদি এক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে চান তাও সম্ভব। এটাই হাজির নাজিরের অর্থ। এটা নয় যে, তিনি বিশেষ শরীরে সর্ব জায়গা সর্বদা উপস্থিত। যেভাবে অনেকে আহলে সুন্নাতের উপর আপত্তি করে। এই উপর ভিত্তি করে বাজে ও অনর্থক আপত্তির দ্বারা শুরু করে দেয়।


হাজির নাজির প্রমাণ করার জন্য তার জীবন ও জীবনের আনুসাঙ্গিক বিষয় কার্য ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হওয়া এবং একি সময়ে একাধিক জায়গায় উপস্থিত হওয়ার প্রমাণ জরুরী।


মাওলানা কাসেম নানুতুবী (رحمة الله) লাতায়েফে কাসেমিয়াতে বলেন, সকল নবীগণ বিশেষভাবে রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে মৃত্যুর বিশ্বাস জরুরী। তবে এই পদ্ধতিতে মৃত্যু ও জীবিত থাকার একত্র হওয়া এভাবে হবে, যেমন নৌকা নড়লে বসা ব্যক্তিও নড়ে। এখানে যেমন থেমে থাকা আসল এবং নড়া প্রাসঙ্গিক। তেমনি ওখানেও জীবিত আসল ও মৃত্যু প্রাসঙ্গিক। অন্য জায়গায় বলেন, অন্তরের আকীদা থেকে জানিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে কোনো দলিল বা দৃষ্টান্তের দিকে ইঙ্গিতও হয়ে যাবে। নবীগণকে তাদের দুনিয়াবী শরীরের সম্পর্কের দিক থেকে বেশি বুঝি।


অন্যত্র বলেন, নবীগণের মৃত্যু ও সাধারণের মৃত্যুর মাঝে এভাবে পার্থক্য হবে, বাতি স্বর্ণের পাত্রে ঢেকে যাওয়া এবং মাটি হয়ে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য।


এই কথার দ্বারা জানা যায়, কাসেম নানুতুবীর মতে রাসূল (ﷺ) এর সাথে মৃত্যু যুক্ত হওয়া রূপক অর্থে। বাস্তবে নয়। যেভাবে নৌকায় বসা ব্যক্তির সাথে নড়া যুক্ত হওয়া রূপক, বাস্তবে নয়। এভাবে নবীগণের সাথে জীবনের বাতি সর্বদা আলোকিত থাকে। কখনো নিভে না। সাধারণের মৃত্যুতো এমনি যে, তাদের মৃত্যুতে জীবনের বাতি নিভে যায়। নবীগণের জীবনের বাতি আগের চেয়ে বেড়ে যায়।


যখন একথা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, নবী (ﷺ) দুনিয়াবী হায়াতের সাথে জীবিত এবং দুনিয়াবী জীবনে তার দৃষ্টির পরিধি এতই বেশি যে, সারা পৃথিবীকে হাতের তালুর মতো দেখো। হাদীসে এসেছে, رفعت لي الدنيا فإنا انظر فيها كما انظر إلى كفي هذه ‘সারা পৃথিবী আমার সামনে পেশ করা হয়েছে। তা আমি হাতের তালুর মতো দেখি।’


❏ প্রশ্ন : উল্লিখিত মর্যাদা দুনিয়াতে অর্জিত ছিলো, মৃত্যুর পরে নয়?


✍ জবাব : حامدا ومصليا ومسلما উপরোক্ত হাদীসেفإنا انظر বাক্যটি মোবতাদা খবর মিলে ইসমিয়া বাক্য হয়েছে। খবরের انظر শব্দটি ফে‘লে মুজারে‘। আর যেই জুমলায়ে ইসমিয়ার খবর ফে‘লে মুজারে হবে সেটা নতুন স্থয়ীত্বের ফায়েদা দিবে। অতএব মৃত্যুর আগে ও পরে উভয়টি সমান।


যদি মেনে নেওয়া হয় যে, দুনিয়াতে রাসূল (ﷺ) এর প্রখর দৃষ্টি অর্জন ছিলো। আখেরাতে এই নেআমত নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাহলে তার আখেরাত দুনিয়া থেকে ভালো থাকবে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وللأخرة خير لك من الأولى ‘আপনার আখেরাত দুনিয়া থেকে ভালো।’

 

যখন একথা প্রমাণ হলো যে, কবরে দুনিয়াবী হায়াত, তাহলে দুনিয়াবী হায়াতের আনুসাঙ্গিক বিষয় প্রমাণিত হবে। إذا ثبت الشئ ثبت بلوازمه ‘বস্তু তার প্রসঙ্গিক বিষয় নিয়েই প্রমাণিত হয়।’ দৃষ্টির প্রশস্ততা যেহেতু দুনিয়াতে প্রমাণিত, তাই কবরেও প্রমাণিত হবে।


মাওলানা কাসেম নানুতুবী (رحمة الله) লতায়েফে কাসেমিয়াতে বলেন, মৃত্যুর সময় নবীগণের হায়াত আরো কঠিন হয়ে যায়। কারণ, হায়াত যখন মূল, তাহলে এই অবস্থায় কখনো কবরে থাকেন, কখনো মি‘রাজের কারণে আসমানে চলে যান।


এই সকল দলিলের আলোকে প্রমাণিত হয়ে গেলো, রাসূল (ﷺ) কবরে বসে সব কিছু দেখছেন। যখন যেখানে চান চলে যান। একই সময় একাধিক জায়গায় চলে যেতে চাইলে তাও সম্ভব।

 
Top