❏ প্রশ্ন-১৭৮: ذوالنون ‘যুন্নুন’ কে ছিলেন এবং তাঁর জীবনকাল কীরূপ ছিল?


✍ উত্তর: ذوالنون ‘যুন্নুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মাছওয়ালা। এটা হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর উপাধি। হযরত ইউনুস (عليه السلام) ছিলেন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মহান নবী। তাঁর পিতার নাম মাত্তা। কিন্তু আব্দুর রায্যাক বলেন, মাত্তা ছিল তাঁর মাতার নাম।

মুহাক্কিকগণ লিখেছেন, হযরত শাইয়ার যামানায় বনী ইসরাইলের রাজা ছিলো ‘হাযক্বিয়া’। ঘটনাক্রমে মুসিল নিতওয়ার জনগণ স্বীয় রাজার সহায়তায় বনী ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করলো, তাদের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে গেলো এবং ৯৫০ জন ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে গেলো। হাযকিয়া এই ঘটনাটি হযরত শাইয়াকে (عليه السلام) বললো এবং আরয করলো যে, যতক্ষণ পর্যন্ত বন্দীদের মুক্ত করা যাবেনা, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিকট থেকে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। কারণ যখন এদিক থেকে সৈন্য যাবে তখন তারা বন্দীদেরকে হত্যা করবে। হযরত শাইয়া (عليه السلام) বললেন, তোমার দেশে ৫ ( পাঁচ) জন নবী আছেন। তন্মধ্যে কাউকে নির্দেশনা সহকারে পাঠাও। তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে বন্দীদেরকে মুক্ত করে আনবেন। হাযক্বিয়া বললো, আপনি কাউকে নির্বাচিত করুন। তিনি বললেন, ইউনুস (عليه السلام) খুবই পরিশ্রমী ও আমানতদার এবং আল্লাহর নিকট প্রিয়। অধিক ইবাদতের কারণে তিনি সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁকে পাঠাও। যদি তারা তাঁকে না মানে, তাহলে তিনি মু’জিযার মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। এ সময় হাযক্বিয়া হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে তলব করলো এবং পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, যদি হযরত শাইয়া (عليه السلام) আল্লাহর হুকুমে নির্বাচিত করেন, তাহলে কোন অসুবিধা নেই, আমি যাবো। অন্যথায় আমার সময়ে ব্যাঘাত ঘটবে। হাযক্বিয়া বললো, আপনার নির্বাচন আল্লাহর হুকুমে নয়, বরং হযরত শাইয়া (عليه السلام) আপনাকে নির্বাচন করেছেন এবং তিনি আদেশ দানের অধিকারী এবং তাঁর আনুগত্য করা ওয়াজিব।

হযরত ইউনুস (عليه السلام) ভারী মনে রওয়ানা হলেন এবং স্বীয় পরিবারবর্গকেও সাথে নিলেন। নিতওয়া হচ্ছে মুসিলের বিপরীতে অবস্থিত এবং তার মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দজলা নদী। সেখানে তিনি গেলেন এবং সম্রাট মাল‘আব ইবনুল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন যে, তুমি বনী ইসরাইলের বন্দীদের মুক্তি দাও। সে বললো, যদি তোমরা সত্যবাদী হতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তোমাদের দেশের ওপর চড়াও করতেন না এবং আমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের বন্দী করে আনতাম না। ওই সময় কি আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করতে অসমর্থ ছিলেন যিনি এখন তোমাকে পাঠিয়েছেন? মোদ্দাকথা, হযরত ইউনুস (عليه السلام) তিন দিন পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করলেন। তবে সে তাঁর কথা মানেনি।

কেউ কেউ বলেন, ওই লোকটি ছিলো মূর্তিপূজক মুশরিক। হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাকে মূর্তিপূজা না করতে বললেন কিন্তু তাঁর কথা সে মানেনি। কারো কারো মতে, তাকে নয় বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। কারো মতে, ২৩ বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছিল। তবে দু’জন লোক ছাড়া কেউ ঈমান গ্রহণ করেনি। অবশেষে হযরত ইউনুস (عليه السلام) রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর দরবারে এই মর্মে সাহায্য প্রার্থনা করেন যে, হে আল্লাহ্! এসব লোক আমার কথা শুনছে না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তাদেরকে ভয়ংকর আযাবের ভয় দেখান। যদি তারা আপনার কথা না শুনে, তাহলে আমি তাদের ওপর আযাব প্রেরণ করবো। সুতরাং হযরত ইউনুস (عليه السلام) কুসা বাজারে ঘুরেফিরে একথা বলতে লাগলেন যে, তোমাদের রাজাকে বলো, সে যদি আমার কথা না মানে, তাহলে আল্লাহ'র আযাব নেমে আসবে।

ওই সব লোকেরা বললো- আযাবের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দাও। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি তোমাদের নিকট কথা দিচ্ছি চলি­শ দিন। যদি এ সময়ের মধ্যে তোমরা আমার কথা মেনে নাও, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায় তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে এ খবর রাজার নিকট পৌঁছে গেলো। বাদশাহ ও মন্ত্রী পরিষদ এ কথায় ঠাট্টা করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, সে একজন ফকীর ও পাগল। তার বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলেন যে, হে আল্লাহ্! আমি ওই সব লোকদের সাথে চলি­শ দিনের অঙ্গীকার করেছি। আমার এই অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো এবং নিহত হয়ে যাবে। কারণ ওই সময় এসব লোকদের স্বভাব ছিলো যে ব্যক্তি এরূপ মিথ্যা অঙ্গীকার করতো, তারা তাকে হত্যা করতো। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তুমি কী কারণে চলি­শ দিনের অঙ্গীকার করেছো। ধৈর্যধারণ করা উচিৎ ছিলো। পরিশেষে তাদের কপালে ঈমান জুটবে। এসব লোক দ্বীনের পথ অবলম্বন করবে।

হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই জবাব শুনে খুবই মর্মাহত হলেন এবং তাঁর অঙ্গীকারকৃত সময় হতে একটি মাস কেটে গেলো। তখন মূর্তিপূজক সম্প্রদায় হতে দশ-বারোটি গোত্র কী হয়- তা দেখার জন্য পৃথক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তিনি সর্বদা এই দু‘আ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ্! আমার অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করুন। নচেৎ আমি অপমানিত হবো। 

যখন ৩৫ দিন হয়ে গেলো তখন সকাল বেলায় আযাবের আলামত দেখা দিলো। ঘন কালো মেঘ ও তীব্র অগ্নির আকারে লু-হাওয়া শুরু হলো। এবং এর প্রভাব রাজপ্রাসাদের অদূরে পৌঁছালো। তখন মন্ত্রীবর্গ সহকারে বাদশাহ অস্তির হয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর বলতে লাগলো এই ছেঁড়াবস্ত্র পরিহিত ফকীরকে অতি দ্রুত খুঁজে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমরা তাঁর হাতে তাওবা করবো এবং কয়েদীগণকে তাঁর হাতে সোপর্দ করবো। অনেকে তাঁকে খুঁজলো, কিন্তু কেউ কোথাও তাঁকে খুঁজে পায়নি। বাদশাহ সহ উপায়হীন নর-নারীর সংখ্যা লাখে দাঁড়ালো। নগ্ন মাথা ও খালি পায়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জঙ্গলে চলে গেলো এবং তাওবার নিয়তে সিজদায় পড়ে আহাজারী করতে লাগলো এবং বলতে লাগলো আমরা ইউনুস (عليه السلام) এর আনীত বিধানের ওপর ঈমান এনেছি। মোদ্দাকথা মহররম মাসের ১০ তারিখ বৃহস্পতিবার তথা চলি­শতম দিনে আছরের সময় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহ ও করুণায় তাদের ওপর থেকে ওই আযাব দূর করে দিলেন এবং আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাদশাহ সহ সকল লোক শহরে প্রবেশ করলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খুঁজে নিয়ে আসার জন্য নানা প্রান্তে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হল। ওপরন্তু বাদশাহ বললো, যদি কোন ব্যক্তি হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর খবর ও খেঁাজ পায়, তাহলে আমি তাকে একদিন সিংহাসনে বসাব। এ সময়ে তার যে সব ধন-সম্পদের প্রয়োজন হবে তা সে নিতে পারবে। সুতরাং এই লোভে অধিকাংশ লোক বেরিয়ে পড়লো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) চলি­শতম দিনের পর ‘নিতওয়া’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তখন গ্রামবাসীর নিকট শুনলেন যে, আযাব স্থগিত হয়ে গেছে এবং তারা তোমাকে খুঁজছে।

তিনি মনে করলেন যে, আমি জাতির নিকট মিথ্যুক হয়ে গেলাম। এখন যদি তাদের নিকট যাই, তাহলে তারা আমাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবে। আর যদি হযরত শিইয়া এর নিকট যাই, তাহলে বনী ইসরাইল এর নিকট বড়ই লজ্জিত হবো। এই ধারণায় হতাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি উভয় কূল ছেড়ে দিলেন এবং ‘রোম’ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যেহেতু হযরত ইউনুস (عليه السلام) এই দু‘আতে অতি দ্রুত ফলাফল প্রার্থনা করেছেন, তাই ভর্ৎসনা শুরু হলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) এ বিষয়টি উপলব্ধি করে স্বজাতির নিকট হতে বেরিয়ে পড়লেন যে, বাইরের লোকেরা আযাবে পতিত হবেনা। তবে আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর সাথে শুরু অন্যরূপ ব্যবস্থা। প্রথমে তো সকল বন্ধু-বান্ধব ও চাকর-বাকর চলে গেলো। একজন নারী ও দু’জন বালক ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গী হলো না। তখন তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন একজন পুত্রকে এবং অপর পুত্রকে কাঁধে নিলেন তাঁর স্ত্রী এবং অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে লাগলেন। পথিমধ্যে একটি বৃক্ষের ছায়ায় বিশ্রাম নিলেন এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে জঙ্গলে গেলেন। এই সময় রাজপুত্রের সাওয়ারী ‘মুবরাসাম’ ওই বৃক্ষের নিকট পৌঁছে গেলো। সে দেখলো দু’জন বালকসহ একজন অতি সুন্দরী ও রূপসী যুবতীর মত একজন নারী বসে আছে। তাই সে নিজের ভৃত্যদেরকে আদেশ দিলো যে, এই নারীকে আমার নিকট নিয়ে এসো। এই নারীটি যার পর নাই অক্ষমতা প্রকাশ করতঃ বললো যে, আমি একজন পূণ্যবান লোকের বিবাহিত স্ত্রী এবং তিনি নবী। তবে মদোম্মত্ত ও যৌবনোম্মত্ত রাজপুত্র তার কথা শুনেনি এবং তাকে সাথে নিয়ে গেলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করতঃ আসার পর স্ত্রীকে পেলেন না। পুত্রদ্বয়কে পেলেন। তারা সংঘটিত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। হযরত ইউনুস (عليه السلام) মনে করলেন, ভর্ৎসনার কর্মকান্ড শুরু হলো। পুত্রদ্বয়কে সাথে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন এবং পথিমধ্যে একটি নদী পড়লো। তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) একজন পুত্রকে নদীর তীরে রাখলেন এবং অন্য পুত্রকে কাঁধে নিয়ে নদী পার হতে লাগলেন। যখন নদীর মধ্যখানে পৌঁছালেন তখন মুখ ফিরিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষমান পুত্রের দিকে তাকালেন এবং এমতাবস্থায় দেখলেন যে, তার দিকে একটি বাঘ ছুটে আসছে। তখন তিনি ভয়ে আবার ফিরে যেতে লাগলেন এবং এমতাবস্থায় তাঁর কাঁধে থাকা পুত্রটি পানিতে পড়ে গেলো এবং কূলে থাকা পুত্রটিকে নিয়ে গেলো বাঘে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) একাকী হয়ে রোম সাগরের তীরে পৌঁছালেন এবং সেখানে ছিলো একটি চলমান জাহাজ। হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমি একজন দরবেশ লোক। যদি বিনা ভাড়ায় আমাকে বসাও, তাহলে আমিও জাহাজ যোগে যাবো। ব্যবসায়ীরা বললো, আপনি আমাদের অক্ষিযুগলে বসুন। আপনার বরকতে আমাদের বিপদ দূর হয়ে যাবে। 

মোদ্দাকথা তিনি জাহাজে উঠলেন এবং জাহাজটি চললো। মধ্য সাগরে হঠাৎ শুরু হলো প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং জাহাজের চলা থেমে গেলো। কেউ কেউ জাহাজটি চালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কারো চেষ্টা ফলোদয় হলোনা। তখন সকলে শলা-পরামর্শ করতে লাগলো। তারা এর কোন কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি। জাহাজটির চালক বললো, আমার এই মর্মে অভিজ্ঞতা আছে যে, যখন কোন দাস স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসে জাহাজে উঠে পড়ে তখন এ ধরনের ব্যাপার সংঘটিত হয়। সুতরাং তোমরা জাহাজে এই মর্মে ঘোষণা দাও যে, যে ব্যক্তি স্বীয় মনিবের নিকট হতে পালিয়ে এসেছে সে যেন পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে বলে দেয়। যখন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিলো তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, আমিই ওই পালানো গোলাম। আমাকে সাগরে নিক্ষেপ করে দাও যাতে জাহাজের আরোহীগণ মুক্তি পায়। লোকেরা বললো, আপনাকে তো কখনো এরূপ অসৎ বলে মনে করা যায় না। অবশেষে লটারী দেওয়া হলো, তখন এতে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। দ্বিতীয়বার আবার লটারী দেওয়া হলো, তখনো হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর নাম উঠলো। অবশেষে নিরুপায় ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে সাগরে নিক্ষেপ করা হলো এবং জাহাজটি রওয়ানা দিলো। ঘটনাক্রমে সাগরে আহারের জন্য অপেক্ষমান একটি মাছ নিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্রই হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে গিলে ফেললো। এই সময় আল্লাহর আদেশ পৌঁছালো যে, সাবধান! এই (হযরত ইউনুস) তোমার আহার নয়। বরং তোমার উদরে আমি তাকে বন্দী করছি। তার শরীর যেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মোদ্দাকথা মাছটি হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে নিয়ে রোম সাগর হতে ‘লাতায়েখ’ নামক স্থানে পৌঁছালো এবং সেখান থেকে গেলো দাজলা নদীতে। মাছের উদরে তিনি সর্বদা আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবে চলি­শ দিন কেটে গেলো। তখন মাছটির ওপর আদেশ দেওয়া হলো যে, এই কয়েদীকে শামী উপকূলে উগরে দাও। মাছটি তৎক্ষণাৎ উগরে দিলো। তাঁর শরীর এরূপ নরম হয়ে গেলো যে, শরীরে মশা-মাছি বসলে তিনি কষ্ট পেতেন এবং এতই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, হাতে মশা-মাছি তাড়ানোর শক্তি ছিলোনা। ওই সময় আল্লাহ তা‘আলা কদু (লাউ) গাছ সৃষ্টি করলেন। কদু গাছ স্বীয় পাতার মাধ্যমে তাঁর ওপর ছায়া হয়ে রইলো এবং এতে তিনি মশা-মাছি হতে রক্ষা পেলেন যেমন- সূরা সাফ্ফাত এর মধ্যে বর্ণিত রয়েছে।

তাফসীরে মুয়ালিমুত তানযিল গ্রন্থে রয়েছে যে, যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) মাছের পেট হতে বের হলেন তখন তাঁকে দুধ পান করানোর জন্য একটি হরিণীর ওপর আল্লাহর নির্দেশ আসলো যাতে তিনি শক্তিশালী হন। চলি­শ দিন পর হরিণীর আসা বন্ধ হয়ে গেলো। যখন দুধ পানের সময় আসলো এবং হরিণী আসলো না তখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্! আজ আমি ক্ষুধার্ত ও বুভূক্ষ। আল্লাহর পক্ষ হতে বলা হলো যে, তুমি এতটুকু স্বভাব পরিবর্তনকে পছন্দ করছো না আর আমাকে আবেদন করেছিলে যে, আমি যেন নিজের অনুপম স্বভাব পরিত্যাগ করে নিজের এক লাখ বান্দাকে মেরে ফেলি। একথা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) তাওবা করলেন এবং আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ্! আমি গুনাহগার আমি লজ্জিত এখন আপনার যে আদেশ আসে তা পালন করবো। আদেশ হলো স্বজাতির নিকট গিয়ে বসবাস করো। যখন স্বজাতির অভিমুখে রওয়ানা হলেন তখন পথিমধ্যে নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যা দ্বারা হযরত ইউনুস (عليه السلام) নিজের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে অবহিত হলেন। যখন তিনি যারপর নাই লজ্জিত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাঁকে দান করলেন নবুয়তের মহান পদমর্যাদা। আর হযরত শাইয়া (عليه السلام) কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত রিসালতের এলাকা (অধিক্ষেত্র) উঠিয়ে নেওয়া হল এবং তাঁকে স্বতন্ত্র রাসূল করা হল এবং প্রত্যেক দিক হতে করুণা-অনুগ্রহের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হল। যখন তিনি ওই নদীর তীরে পৌঁছলেন যেখানে তিনি দুই পুত্রকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন দেখলেন যে, গ্রামের লোকেরা দু’জন বালককে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই বালক কার? তারা বললো, তারা একজন বুযূর্গ ব্যক্তির পুত্র। একজনকে আমরা বাঘের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছি এবং অন্যজনকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় ধোপারা উদ্ধার করে আমাদেরকে দিয়েছে। তাই আমরা তাদেরকে লালন-পালন করি এবং এ অপেক্ষায় আছি যে, ওই বুযূর্গ লোকটি পেলে তাকে সোপর্দ করবো। এতক্ষণে বালকদ্বয় হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে চিনে নিলো। তারা বললো, তিনিই আমাদের পিতা। তখন ওই লোকেরা পুত্রদ্বয়কে তাঁর নিকট সোপর্দ করলো। যখন হযরত ইউনুস (عليه السلام) পুত্রদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং ওই বৃক্ষের নিকট গেলেন যেখান থেকে রাজপুত্র তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলো তখন সেখানে অপেক্ষমান কিছু লোক দেখতে পেলেন। হযরত ইউনুস (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা বসে আছো কেন? তারা বললো, আমাদের রাজপুত্র একদিন শিকারের জন্য বের হয়েছিলো এবং তখন জনৈক দরবেশের স্ত্রীকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। ওই দিন হতে সে পেট ব্যথায় আক্রান্ত। আমাদের রাজা আমাদেরকে এই জন্য নিয়োজিত করেছেন যে, আমরা যেন তাকে দেখা মাত্রই রাজ দরবারে নিয়ে যাই। সেখানে বাদশাহ অপরাধের ক্ষমা চেয়ে নেবেন এবং তার স্ত্রীকে সোপর্দ করবেন। আর ওই নারীটিকে এখনো কেউ স্পর্শ করেনি। এই কথা ও অবস্থা শুনে হযরত ইউনুস (عليه السلام) বললেন, ওই ফকীর-গরীব লোকটি আমি। তখন বাদশাহর সিপাহীগণ যথাযথ ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে বাদশার নিকট পৌঁছালো। তিনি বাদশার নিকট পৌঁছা মাত্রই রাজপুত্র সুস্থ হয়ে গেলো এবং বাদশাহ তাঁকে তাঁর স্ত্রী সোপর্দ করলো এবং বহু অর্থরাজি ও জিনিসপত্র উৎসর্গ করলো। তিনি যখন ‘মুসিল ও তিনওয়া’ সীমান্তে পৌঁছালেন তখন মানুষকে সংবাদ দেওয়ার জন্য একজন লোক পাঠালেন। যখন এই সংবাদ বাদশার নিকট পৌঁছালো তখন সে মন্ত্রীবর্গ সহকারে উপস্থিত হলো এবং পূর্ণ মর্যাদা সহকারে তাঁকে শহরে নিয়ে গেলো। বাদশাহ অনেক দিন পর্যন্ত তাকে অনুসন্ধান করেছিলো। বাদশাহ যখন মৃত্যুবরণ করলো তখন একজন লোককে খলিফা বানালেন এবং ৭০ (সত্তর) জন অতি আবেদ লোকসহ নিজে ‘সায়হুন’ পাহাড়ে তাশরীফ নিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদতে নিমগ্ন হলেন। ওই স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ (ষাট) বছর। সূরা নূন ও সাফ্ফাত এর মধ্যে তাঁর ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে।


❏ প্রশ্ন-১৭৯: যখন কোন জাতির ওপর আযাব চলে আসে তখন আযাব চলে আসার পর ঈমান আনা ফলদায়ক নয়। তবে হযরত ইউনুস (عليه السلام) এর জাতির ওপর মেঘরাজি আসার পরেও যখন তারা ঈমান আনলো তখন তাদের ওপর আযাব উঠিয়ে নেওয়া হলো, এর পেছনে রহস্য কী?


✍ উত্তর: তাবারানী শরীফের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনওয়া শহরে যখন আযাবের আলামতসমূহ দৃশ্যমান হতে লাগলো এবং হযরত ইউনুস (عليه السلام)কে খেঁাজার পরও পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন শহরবাসী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের জনৈক আলেমের নিকট গেলো যিনি ছিলেন ঈমানদার ও সমকালীন শায়খ এবং তাঁর নিকট তারা আর্তি জানালো। তখন তিনি আদেশ দিলেন, তোমরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করো,


 يا حىّ حين لا حىّ يا حىّ يحى الموتى يا حىّ لا الٰه الّا انت


সুতরাং লোকেরা এই দু‘আটি পড়ে প্রার্থনা করলো এবং আযাব দূর হয়ে গেলো। তবে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও কারামতের অধিকারী ওলী হযরত ফুযাইল বিন আয়ায (رحمه الله تعالي ) বলেন, যে দু‘আটির বরকতে তিনওয়া শহরের আযাব দূর হয়ে গিয়েছিলো সে দু‘আটি ছিলো এটি যে,


اَللهم ان ذنوبنا قد عظُمتْ وجلَّت وانت اعظُم واجلُّ فا فعل بنا ما انت اهلهُ ولا تفعل بنا ما نحنُ اهلهُ . 


মোদ্দাকথা আযাব দূর হয়ে যাবার পর হযরত ইউনুস (عليه السلام) যখন শহরের সন্নিকটে আসলেন তখন তিনি শহরে আযাবের কোন চিহ্ন বা নিদর্শন দেখেননি। লোকেরা বললো, আপনি স্বজাতির নিকট চলে যান। তিনি বললেন, আমি কিভাবে স্বজাতির নিকট যাবো? আমি তো তাদেরকে আযাবের সংবাদ দিয়ে শহর হতে বের হয়ে পড়েছি, তবে আযাব আসেনি। তাই এখন এসব লোকেরা আমাকে মিথ্যুক মনে করে হত্যা করে ফেলবে। তিনি নিকষ কালো অন্ধকার মাছের পেটে বন্দী হলেন। তবে ওই পরিস্থিতিতে তিনি এই আয়াতে কারিমার لَا إله الّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ . ওজিফা শুরু করে দিলেন। তাই এর বরকতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই অন্ধকার হতে মুক্তি দিলেন।

 
Top