❏ প্রশ্ন-২১৫: ســبـأ‘ (সাবা) এর তাফসীর ও তাহকীক বর্ণনা কর ?

✍ উত্তর: কোরআন মজিদে সূরা সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,


لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .


‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য যিনি এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং আবাসিক গড়েছেন, যিনি পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’ 

283. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭


‘সাবা’ ইয়ামেনের বাদশাহ ইয়াশহাব-এর অপর নাম। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের ধারণা মতে, সাবা ইয়াশহাবের সন্তানের নাম। তার সন্তানেরা পুরুষত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর এ সকল বংশধরেরা সাবা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাদের লোকজন বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতো এবং বস্তিসমূহকে আবে মাআরিব’ বলা হতো। উক্ত বস্তিসমূহ সান‘আ শহর থেকে তিন মাইল দূরত্বে অবস্থিত।

হযরত ইবনে আব্বাস (رضى الله تعالي عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করল, কোরআনে উল্লেখিত ‘সাবা’ কোন পুরুষের নাম, না নারীর, না কোন ভূ-খন্ডের নাম? রাসূলুল্লাহ   বলেন, সাবা একজন পুরুষের নাম। তার দশজন পুত্র সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ছয়জন ইয়ামেনে এবং চারজন সিরিয়া দেশে বসতি স্থাপন করে। ইয়ামেনে বসবাসকারী ছয় পুত্রের নাম: ইযদ্, আশ‘আরী, হিমইয়ার, কেন্দা, মাদজাজ ও আন্মার এবং সিরিয়া দেশে বসবাসকারীদের নাম: লখম, জুযাম, গাস্সান ও আমেলা। প্রত্যেক সন্তানেরা এ নামেই সুবিদিত।

তাদের গোত্রীয় নামও এ নামেই পরিচিত ছিল। হিম্ইয়ারের বংশে ইয়ামেন সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হয়। আন্মারের পুত্র সাদ্দাদ উক্ত সাম্রাজ্যের বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার ভাই লোকমান ইবনে আদ বাদশাহ হন। এরপর তার অপর ভাই যুসদ ক্ষমতাসীন হয়। অতঃপর তার সন্তান হারিস ইবনে তুব্বা‘ ক্ষমতাসীন হন, যিনি প্রথম তুব্বা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তারপর তার সন্তান সা‘আব বাদশাহ হন, তাঁকে যুল-কারনাইনও বলে। অতঃপর পুত্র যুল-মানার আবরাহ, অতঃপর তার পুত্র আফরিক্বশ, অতঃপর তার ভাই যুল-আগার, অতঃপর তার ভাই শারজীল, অতঃপর তার পুত্র আল-হাদ্দাদ বাদশাহ নির্বাচিত হন। অতঃপর তার কন্যা বিলকিছ বাদশাহ হন। সাবার বংশধরের মধ্যে যে ছয়জন বাদশাহ ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ঈমানদার, পূন্যবান ও নেককারও ছিলেন। যেমন- তুব্বা’, যুল-কারনাইন। কয়েকজন মূর্তিপূজারী কাফির ছিলেন।

কয়েকজনের রাজত্ব আরব সাম্রাজ্য অতিক্রম করে সুদূর মিসর, সিরিয়া, ইরান ও হিন্দুস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। উক্ত বাদশাহগণের স্মৃতিস্বরূপ গামদান-এর অট্টালিকাসমূহ এখনো তার স্বাক্ষর বহন করছে। এগুলোর মধ্যে ওই বাঁধও প্রাচীনতম স্মৃতি বহন করছে যেমন কারো মতে, সম্রাজ্ঞী বিলকিস বর্ষার পানি আটকানোর জন্য বাঁধ তৈরী করায়েছিলেন। সমস্ত নালার পানি ওই বাঁধে আটকা পড়ে জমা হয়ে যেত। সেখান থেকে ছোট ছোট নালা বের করে ক্ষেত-খামার ও বাগানগুলোতে পানি সরবরাহ করা হতো। রাস্তার উভয় পাশের্ব বাগান ছিল এবং পানির সুবিধার্থে অনেক বসতবাড়ি সেখানে স্থাপিত হয়েছিল। এ শস্য-শ্যামলতা ও সজীবতা অনেক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যার ফলশ্রুতিতে পর্যটকগণ অতি সহজে ও নিরাপদে অনেক দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হতো। উক্ত নিয়ামতকে লোকেরা সাধারণ বিষয় মনে করতে লাগল, যার ফলাফল এটাই হলো যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে বাঁধ ভেঙ্গে পানি সমস্ত বস্তি ও আবাদী বাগানসমূহ বন্যার স্রোতে ভেসে নিয়ে গেল।

সুতরাং কোরআন মজিদে সূরা আন-সাবা’র দ্বিতীয় রুকুতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন,


لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ ......... وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ .


‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তাদের আবাস ভূমিতে ছিল আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের এক মহান নিদর্শন- দু’টি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বামদিকে। আমরা তাদেরকে নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তিনি পৃথিবীতে অবস্থানের জন্য এতো স্বাস্থ্যকর শহর এবং পরকালে অপরাধ ও গুনাহ ক্ষমাকারী পালনকর্তা। অতঃপর তারা আমার হুকুমের অবাধ্যতা করল, ফলে আমি বাঁধ ভেঙ্গে তাদের ওপর প্রবল বন্যা দিয়ে গোটা এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তাদের বাগানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটাই ছিল কুফরীর কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া কাউকে শাস্তি দিই না।’ 

284. সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭


আমি সাবা বাসীদের বস্তিসমূহ এবং সিরিয়ার গ্রামবাসীর মধ্যস্থিত এলাকায় উৎপাদনে যে বরকত দিয়েছিলাম এবং অনেক গ্রাম আবাদ করে রেখেছিলাম যা পরস্পর পাশাপাশি হওয়াতে দেখা যেত। উক্ত গ্রামে পর্যটকদের চলাচলের জন্য সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, যাতে তারা নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে দিবারাত্র চলাফেরা করতে পারে। তখন তারা বলতে লাগল যে, হে আমাদের প্রতিপালক! এতবেশী পাশাপাশি এলাকায় সফর করাতে সফরের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি আমাদের ঘর-বাড়ী দূরে দূরে করে দাও। সারকথা হচ্ছে, তারা উক্ত নিয়ামতসমূহের মূল্যায়ন না করে তারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছে। অতএব আমি তাদেরকে এভাবে বিলীন করে দিয়েছি যে, তাদের ঘটনা কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যানে পরিণত করে দিয়েছি। আমি তাদের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ ও ধৈর্য্যশীল বান্দা রয়েছেন, সাবা সম্প্রদায়ের কাহিনীতে তাদের জন্য রয়েছে বড় শিক্ষনীয় বিষয়। শয়তান যে সকল লোকদের সম্পর্কে তার মতামত পেশ করেছিল যে, তারা তার সঙ্গ দেবে, বাস্তবিকই সে তার রায়কে সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, উক্ত লোক সকল তার সঙ্গ দিয়েছে এবং তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু ঈমানদারদের এক জামাত যারা তার প্রতারণা ও প্রলোভনে প্রতারিত হয়নি বরং শয়তানের তো তাদের ওপর কোন ক্ষমতাই ছিল না। আমি তার ব্যাপারে একটি কৌশল করে রেখেছিলাম, যার আসল উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, যে সকল লোক পরকালে বিশ্বাসী আমি তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখব। আর যাদের সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে এবং শয়তানের প্ররোচনায় নিপতিত হয়েছে তাদেরকেও পৃথক করব। অতএব, হে রাসূল  ! তোমার প্রতিপালক প্রত্যেক বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রত্যেক বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। ‘সাবা’ কোরআন মজিদের চৌত্রিশতম সূরার নাম। এটির তাফসীর যে-কোন তাফসীর গ্রন্থ থেকে জেনে নিন।

(আমি শয়তানকে পরকালে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য কৌশল বা ফাঁদ হিসেবে রেখেছি, যাতে তার অনুসারী ও অনানুসারীদের পৃথক করা যায়।)


"تمت بالخير"

 





    সমাপ্ত
 
Top