কারো উপর মিথ্যা অভিযোগ করা শরীয়তে কতটা অপরাধ?
একজন মুসলমানের পক্ষে মন্দ ও পাপের সাথে জড়িত হওয়া অবশ্যই খারাপ, তবে মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগ করা আরও খারাপ। আমাদের সমাজে প্লেগের মতো যে কুফল ছড়াচ্ছে তার মধ্যে একটি হল অপবাদ এবং মিথ্যা অভিযোগ। চুরি, ঘুষ, জাদুবিদ্যা, অনৈতিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, হত্যার মতো মিথ্যা অভিযোগ আমাদের ঘর-বাড়ি ব্যয়-ব্যবসা এবং অফিস আদালত ইত্যাদি প্রত্যেকটা মহলের জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে।
عَنْ يَحْيَى بْنِ رَاشِدٍ، قَالَ: جَلَسْنَا لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ فَخَرَجَ إِلَيْنَا فَجَلَسَ، فَقَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ حَالَتْ شَفَاعَتُهُ دُونَ حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ، فَقَدْ ضَادَّ اللَّهَ، وَمَنْ خَاصَمَ فِي بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ، لَمْ يَزَلْ فِي سَخَطِ اللَّهِ حَتَّى يَنْزِعَ عَنْهُ، وَمَنْ قَالَ فِي مُؤْمِنٍ مَا لَيْسَ فِيهِ أَسْكَنَهُ اللَّهُ رَدْغَةَ الْخَبَالِ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ صحيح
ইয়াহইয়া ইবনু রাশিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু )-এর অপেক্ষায় বসে রইলাম। তিনি বেরিয়ে এসে আমাদের নিকট বসলেন এবং বললেন,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ যার সুপারিশ আল্লাহর নির্ধারিত কোন হাদ্দ বাস্তবায়িত করার পথে বাধা সৃষ্টি করে, সে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যে ব্যক্তি জেনে বুঝে মিথ্যা মামলা দেয়, সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। যে ব্যক্তি কোন ঈমানদারের এমন দোষ বলে বেড়ায় যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের আবর্জনার মধ্যে বসবাস করাবেন। অতএব তাকে শীঘ্রই তার কথা থেকে তাওবা এবং ত্যাগ করা উচিত।
(আবু দাউদ শরীফ হাদীস ৩৫৯৭)
** শত্রুতা ও নিজের বদনামী অথবা কোনও বদলা নেওয়া উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রচার ও প্রসার এর উদ্দেশ্যে অপরকে অভিযুক্ত করে নিজের আশা পূরণ করে নেয় কিন্তু
যাকে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করা হয় তিনি তার সারাজীবন লজ্জা ও অপমানের মুখোমুখি হন। কখনও কখনও মিথ্যা অভিযোগও ভুল বোঝাবুঝির ভিত্তিতে করা হয়।
একটি কাল্পনিক গল্প থেকে বুঝুন। মহিষটি চুরি হয়ে গেছে, গ্রামের স্কুল মাস্টার ( শিক্ষক ) Teacher ) বসে আছেন , হঠাৎ সেখানে এক গ্রামবাসী হাঁপিয়ে উঠলেন এবং জোরে বললেন: মাস্টার! আপনার ঘেরায় সেই মহিষটি পাওয়া গেছে। এই কথা শুনে মাস্টার সাহেব মাথা নাড়লেন।পঞ্চায়েতের লোকেরাও অবাক হয়ে গেল, কিন্তু তারা মাস্টার সাহেবের সামনে কিছু বলার সাহস পেল না, তাই তারা একে একে পিছিয়ে গেল। গ্রামবাসীও চলে গেল। মাষ্টার সাহেব সেখানে বিব্রত ও অনুশোচনা অবস্থায় বসেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই, গ্রামবাসী আবার দৌড়ে এসে মাস্টারের পা ধরে বললেন: আমাকে ক্ষমা করুন! মহিষটি আপনার ঘেরায় পাওয়া যায় নি তবে সংলগ্ন ঘেরায় পাওয়া গেছে । মাস্টার জি কেবলমাত্র ধাক্কায় পড়ে বলতে পারেন: এখন আপনি যদি পুরো গ্রামে কোনও ঘোষণা করেন, তবে কোনও লাভ নেই কারণ লোকেরা এখন আমাকে “চোর” হিসাবে স্মরণ করবে ।
হযরত মা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) – এর উপর যখন মিথ্যা অভিযোগ করা হয় তখন আল্লাহ তা’আলা তার নিন্দা করে তা বড় গুনাহ বলে আখ্যায়িত করেছেনঃ
তোমরা যখন এ কথা শুনলে তখন কেন বললে না যে, এ বিষয়ে কথা বলা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ তো পবিত্র, মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ।(সূরা নূর, আয়াত ১৬)
হযরত মাওলানা শাহ ইমাম আহমদ রাজা খান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লিখেছেন: কোনও মুসলমানের উপর মিথ্যা অপবাদ লাগানো হারামে ক্বাতঈ(কঠিন হারাম) ,
বিশেষ করে যদি জেনা-এর অপবাদ হয় (ফাতাওয়া রেযবীয়া ২৪ খণ্ড, ৩৮৬পৃঃ)
** কোনও মহিলা- কে মিথ্যাভাবে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা আরও বিপজ্জনক। তারা এটাও ভাবে না যে তার এবং তার পরিবারের লোকেদের দিলে কত বড় আঘাত লাগবে এবং তার জীবনটা কী হবে? সারা জীবনের মতো তার গায়ে একটা কালি লেগে যাবে।
**. যে ব্যক্তি কোন মহিলাকে যেনা(ব্যভিচার) – এর অভিযোগ দেয় এবং চারজন সাক্ষীর সাহায্যে প্রমাণ করতে না পারে, তার ধর্মীয় শাস্তি হল “হাদ্দে কাজফ “, অর্থাৎ তাকে ইসলামের বাদশা অথবা কাজী (ধর্মীয় বিচারক) – এর আদেশে ৮০ বার কোড়া(চাবুক) মারানো হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে চার জন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। এরাই না’ ফারমান।(সূরা নূর, ৪ নম্বর আয়াত)
এখানে আপনি পরকালের ক্ষতিও শুনে নেন! ,
নাবী( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
ان قذف المحصنة يهدم عمل مائة سنة
অর্থাৎঃ কোনও সতী নারীর প্রতি মিথ্যা অভিযোগ লাগানো নিজের একশো বছরের নেকী ধংস করে দেয়।
(আল-মো’জামুল কাবির হাঃ ৩০২৩)
** অর্থাৎ
যদি কোনও ব্যক্তি একশত বছর বেঁচে থাকে এবং উপাসনা (ইবাদত) করে তবেও এই অপবাদ তার কর্মকে বাতিল করে দেবে।
( ফাইযুল ক্বাদীর, খণ্ড, ২, পৃষ্ঠা ৬০১, ২৩৪০ নম্বর হাদিসের অধীনে)
عَنِ الْعَلاَءِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ ” . قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ . فَقَالَ ” إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ ” .
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা কি বলতে পার, অভাবী লোক কে? তারা বললেন, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা কড়ি) ও ধন-সম্পদ নেই সে তো অভাবী লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে ব্যক্তি কিয়ামাতের দিন সলাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক ‘আমাল থেকে দেয়া হবে, অমুককে নেক আমাল থেকে দেয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হক তার নেক ‘আমাল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
(মুসলিম শরীফ হাঃ ৬৪৭৩)
** না জেনে না শুনে প্রমাণ ছাড়া কোনও লোকের সম্পর্কে মন্দ মন্তব্য করাই গুনাহ।
মিথ্যা অভিযোগ করলে তাওবা করা এবং তার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া জরুরী। তাছাড়া যাদের কাছে অভিযোগ ব্যাক্ত করেছে তাদের নিকট গিয়ে এটা বলা জরুরী যে উমকের সম্পর্কে আমি যা বলেছিলাম মিথ্যা বলেছিলাম (বাহারে শরীয়াত ৩ খণ্ড, ৫৩৮ পৃঃ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে আমি স্বপ্নে বেশ কয়েকটি দৃশ্য দেখেছি, তিনি আরও বলেছেন যে কিছু লোককে জিহ্বা দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার সাথে জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম ) ছিলেন তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন যে তারা বিনা কারণে মানুষকে দোষারোপ করতো। (শারহুস সাদূর, পৃষ্ঠা 184 )
সুতরাং অবিলম্বে তাওবা করুন আপনার এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে, নিন্দা ও অপবাদের অনুশোচনা করুন।