গোলাম শাফিউল আলম মাহিন: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইমাম, ভাষা সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শায়খুল ইসলাম, উস্তাজুল উলামা ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী মঙ্গলবার ভোর ৫:২৫ মিনিটে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার এ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে দেশের আলেম সমাজের মধ্যে। 


ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী আউলিয়ায়ে কেরামের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পাঁচলাইশ বর্তমানে বায়েজীদ থানার অন্তর্গত জালালাবাদের এক ধর্মভীরু সম্ভ্রান্ত মুসলিম কাযী পরিবারে হাশেমী বংশে ১৯২৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর, ১৫ রজব জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা শাহ্ সুফী মাওলানা কাযী আহ্ছানুজ্জমান হাশেমী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন প্রসিদ্ধ হাশেমী বংশের একজন কৃতিপুরুষ। তাঁর মাতা ছিলেন বাংলার মোহাদ্দেসে আযম অলিয়ে কামেল চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতীব আল্লামা ছফিরুর রহমান হাশেমী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর ঔরসজাত কন্যা।

আল্লামা হাশেমী জমাতে উলা পাশ করে ওয়াজেদীয়া মাদ্রাসায় একবছর যাবৎ দরস দানে লিপ্ত থাকেন। তখন তাঁর অন্তরে কামিল ডিগ্রী অর্জন করার প্রবল আগ্রহ জন্মে। তৎকালীন উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসাকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে আল্লামা হাশেমী ঢাকা গমন করেন এবং তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-ই আলীয়া ঢাকাতে ১৯৫১ সালে টাইটেল ক্লাশের হাদীস বিভাগে ভর্তি হন। তথায় তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে হাদীস শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এদিকে ওই সময়ে তিনি সন্ধ্যাকালীন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে উর্দুতে ডিপ্লোমা কোর্সও সম্পন্ন করেন। তিনি তখনকার সময়ের পাক ভারতের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আলেম শরীয়ত ও তরিকতের মাজমাউল রাহরাইন আরবী ও উর্দু ভাষায় বিভিন্ন বিষয়াদির উপর অগণিত গ্রন্থ রচয়িতা প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মুফ্তি সৈয়দ আমীমুল এহছান মুজাদ্দেদী বরকতী কুদ্দেসা সিররুহুর সান্নিধ্যে থেকে ইলমে হাদীস, ফেকাহ, তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ের উপর গবেষণা করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৫২ সালে হযরত মুফতী সাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁকে “নাইলুল মুরাম বে-আসানিদে আশ্ শায়খ নূরুল ইসলাম” বিশেষ সনদ ও সম্মাননা প্রদান করেন। এছাড়া তিনি প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি )-এর স্নেহ লাভেও ধন্য হন।

ঢাকা হতে হুযুর কেবলা শিক্ষা সমাপনীর পর স্বীয় বাড়ীতে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র চট্টগ্রাম ওয়াজেদীয়া আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগ দেন এবং প্রধান মুহাদ্দিসের পদ শূন্য হলে তিনি উক্ত পদে নিযুক্ত হন। মাদ্রাসার অভ্যন্তরে তাঁকে টাইটেল সাহেব সম্বোধন করা হতো।  এছাড়াও তিনি পটিয়া শাহ্চাঁন্দ আউলিয়া আলীয়া মাদ্রাসা, ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলীয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী অদুদিয়া সুন্নীয়া মাদ্রাসায় বেশ কিছুদিন যাবৎ হাদীসে নববী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-এর খেদমত আঞ্জাম দেন। অতুলনীয় আশেক্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম হুযুর কেবলা আল্লামা হাশেমী তরিকতের মহান দায়িত্ব পালন করছেন এবং দেশের আনাচে কানাচে ওয়াজ নসিহত ও ভাষণ বক্তৃতার মাধ্যমে সর্বসাধারণের মধ্যে দ্বীনের সঠিক মতাদর্শ আকাঈদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে প্রতিষ্ঠা করার মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

হুযূর কেবলা আল্লামা হাশেমী মুদ্দাজিল্লুহুল আলী ১৯৮০ সালে জামাতে আহলে সুন্নাতের অঙ্গসংগঠন হিসেবে আকাঈদে আহলে সুন্নাতের ধারক বাহক এদেশে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনরত একক সুন্নী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা গঠনে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সুদৃঢ় করণে হুযুর কেবলা আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বর্তমানে এদেশের সুন্নী আকীদা ভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিরাট দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, আহলে সুন্নাত সম্মেলন সংস্থা-বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, এদেশের আ‘লা হযরত চর্চা ও গবেষণার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আ‘লা হযরত ফাউন্ডেশন-বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, জাতীয় ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উদযাপন কমিটির সম্মানিত আহ্বায়ক।

হুযূর কেবলা আল্লামা হাশেমী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী নিজ বাড়ীতে ১৯৬৪ সালে আহ্ছানুল উলুম জামেয়া গাউছিয়া আলীয়া মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠায়  অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মাদ্রাসার সাথে মসজিদে গাউছিয়া রেফাঈয়া-এরও ভিত্তি দেন। এছাড়াও হুযূর কেবলা বিভিন্ন স্থানে অগণিত মসজিদ ও মাদ্রসা স্থাপন করেন। ১৯৮৭ সালে হুযুর কেবলা আধ্যাত্মিক তরিকত ভিত্তিক সংগঠন “আঞ্জুমানে মুহিব্বানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গাউছিয়া জিলানী কমিটি” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় হুযূর কেবলার সভাপতিত্বে ১২ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শীর্ষক সেমিনার বর্তমান সময়কার দেশ বিখ্যাত মাহফিলে পরিণত হয়েছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-এর ৬৩ বছরের হায়াতে তাইয়্যেবা আলোচনার উপর গবেষণাধর্মী ও রূহানী মাহফিল হিসেবে তা ঈমান আক্বীদা হেফাজতকারী। ছাত্র ও যুবকদের সুন্নীয়ত ও তরীকতের দিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁরই নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গাউছিয়া হাশেমী কমিটি-বাংলাদেশ।

শোক প্রকাশ: ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশ এর সম্মানিত চেয়ারম্যান আল্লামা মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী (মা.জি.আ), মহাসচিব সৈয়দ মছিহুদ্দৌলা (মা.জি.আ), নির্বাহী মহাসচিব মুফতি আবুল কাসেম ফজলুল হক, চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার সম্মানিত অধ্যক্ষ মাওলানা মুফতি অছিউর রহমান আল কাদরী, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সম্মানিত সভাপতি মাওলানা এম.এ মান্নান, মহাসচিব এম. এ মতিন, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব এডভোকেট মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, কেন্দ্রীয় ছাত্রসেনা সভাপতি জি.এম. শাহাদাত হোসেন মানিক, সেক্রেটারি ইমরান হোসাইন তুষারসহ দেশের শীর্ষ এবং সকল সুন্নি উলামায়ে কেরাম। ইমামে আহলে সুন্নাতের ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন সুন্নি বিশ্বকোষের সকল এডমিন, মডারেটর এবং এডিটরবৃন্দ। মহান আল্লাহ হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।
Top