🌀 মুনাফিকের পরিচিতি ও পরিণতি 👥

মুনাফিক শব্দটি এসেছে আরবি থেকে যার বহু বচন হচ্ছে মুনাফিকুন। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে কপটতা, ভন্ডামী, প্রতারণা ইত্যাদি।

মুনাফিকি তথা ভন্ডামী বা কপটতা একটি মারাত্মক রোগ। বিশ্বাসগত দিক থেকে কুফরির নিকৃষ্টতম দিক হলো মুনাফিকি। মুনাফিকদের বিষয়ে পবিত্র কোরআনে শতাধিক আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে এবং মুসলিমদের জন্য অমুসলিম শত্রুর তুলনায় মুনাফিকরা অধিকতর বেশি বিপজ্জনক শত্রু।

মুনাফিকরা মূলত দুমুখো সাপ যার অন্তরে কুফরি থাকে এবং মুখে নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা কাফিরও না আবার মুমিনও না বরং এর মাঝামাঝিতে এদের অবস্থান। এরা ইসলাম তথা পুরো মানবসমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ।

মুনাফিক সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মাজীদের সূরা আত-তাওবাহতে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন যে, ‘হে প্রিয় নবী! জিহাদ করুন অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে, আর কঠোর হন তাদের প্রতি। তাদের শেষ আবাসস্থল হচ্ছে জাহান্নাম এবং মন্দ সেই গন্তব্যস্থান!’

( সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত – ৭৩)

প্রথমত, ‘মুনাফিক’ শব্দটির উৎপত্তি ‘নিফাক’ শব্দমূল থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ভেতরে কোনো কিছু গোপন রেখে বিপরীত কথা বা কাজের প্রকাশ। ইসলামী পরিভাষায় মুনাফিকরা অন্তরে কুফরি এবং মুখে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশ করে বেড়ায়। মুনাফিকদের এই কাজের ব্যাখ্যায় পবিত্র কোরআনে এক আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহ ও মুমিনদের ধোঁকা দিতে চায়, তারা আসলে নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারছে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৯)

দ্বিতীয়ত, মুনাফিক শব্দটির উদ্ভব হয়েছে নফক শব্দ থেকে যার অর্থ- ছিদ্র, গর্ত, বের হওয়া, সুড়ঙ্গ, খরচ করা, ব্যয় করা। কারো কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বা পাহাড়ি ইঁদুর থেকে মুনাফিক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ এরা উভয় অত্যন্ত ধূর্ত হয়, এদের সহজে চিন্হিতক করা যায় না। মুনাফিক দুই ধরনের হয় যথা:

(১) বিশ্বাসগত মুনাফিকি,
(২) কর্মগত মুনাফিকি।

যে মুনাফিকরা অন্তরে কুফরি রেখে নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে তারা হলো বিশ্বাসগত মুনাফিকি।

এবং কর্মগত মুনাফিক হচ্ছে তারা যারা -আমানতের খিয়ানত করে, মিথ্যা বলে, ওয়াদা ভঙ্গ করে, ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করে ইত্যাদি ।

প্রিয়নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে আছে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এই চারটির একটি স্বভাবও থাকবে সেও মুনাফিকের কাতারে থাকবে। স্বভাব চারটি হলো:
(১) আমানতের খিয়ানতকারী,
(২) মিথ্যাবাদী,
(৩) ওয়াদা ভঙ্গকারী,
(৪) ঝগড়ার সময় গাল-মন্দ কারী।

(সহীহ বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)

এগুলো ছাড়াও মুনাফিকদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা তাদের চলাফেরা, কথা-বার্তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। নিচে বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

(১) মুনাফিকরা মহান আল্লাহ’র মুমিন বান্দাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসি তামাশা করে,

(২) মুনাফিকরা অহংকারী হয় যা তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়,

(৩) মিথ্যা বলতে বলতে এদের হ্রদয় মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়,

(৪) মুমিনদের মূর্খ আখ্যা দেয়া এবং ইসলামের পথে ব্যয়ে বাধা দান করে,

(৫) পবিত্র কোরআনে আয়াত সমূহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে,

(৬) অন্যের সম্পদ হরণ করে,

(৭) মানুষের সঙ্গে বিনা কারণে বিবাদের জড়ায়,

(৮) কাফেরদের সঙ্গে সখ্যতা থাকে,

(৯) মহান আল্লাহ’র সঙ্গে বিদ্রোহ করে এবং ইবাদতের অলসতা করে,

(১০) অনিশ্চয়তা বা দোটানায় ভোগে এবং মুমিন দের সঙ্গে ধোঁকাবাজী করে,

(১১) ভীত, কাপুরুষতা, অস্থিরতা ইত্যাদি এদের মধ্যে লক্ষনীয়।

মুনাফিকদের শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদীস সমূহতে কঠিন বর্ণনা দেয়া আছে। ইহকালে মুনাফিকরা সম্মানের অধিকারী হতে পারেনা, সাড়াজীবন অপবাদ, ঘৃণা, অসম্মান, এইসব নিয়েই বেঁচে থাকে হয় এবং মৃত্যুর পরেও ভোগ করতে হয় জাহান্নামের কঠিন আযাব। মুনাফিকদের শাস্তি সম্পর্কে ইসলামের পবিত্র ধর্মীয় কিতাব পবিত্র আল কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

‘নিশ্চয়ই মুনাফিকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর।’ (সুরা: নিসা, আয়াত: ১৪৫)

এছাড়াও সূরা আত-তাওবাহতে মহান আল্লাহ পাক ওয়াদা করেছেন যে, ‘মুনাফিক পুরুষ, নারী এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে দোজগের আগুন এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। সেটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী আযাব।’

(সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৮)

মুনাফিকদের মৃত্যুর পরে তাদের জানাযা পড়া নিয়ে রাসূল  ﷺ এর একটি হাদীসও বর্ণিত আছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন যে- আব্দুল্লাহ বিন উবাই নামক মুনাফিক নেতা যখন মৃত্যু বরণ করলেন তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল যে, হে রাসূল আপনার পরিধেয় কাপড়টি চাই আমার পিতার কাফনের কাপড় হিসেবে এবং আপনি আমার পিতার জানাযার নামাজ পড়াবেন ও তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।

এ কথা শুনে রাসূল তার কাপড় দিলেন এবং জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য যথা সময়ে প্রস্তুতি নিলেন। এই কথা হজরত ওমর (রা.) শোনা মাত্র এসে রাসূলুল্লাহর জামা টেনে ধরলেন এবং বললেন হে রাসূল, মুনাফিকদের জানাযা পড়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নিষেধ করেননি কি? তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন দোয়া পড়া না পড়া উভয় আমার ইচ্ছা, আল্লাহ পাক এই ব্যাপারে আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই কথা বলে রাসূল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাযা পড়ালেন।

এই ঘটনার পরে মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে রাসূল  ﷺ  এর কাছে ওহী নাজিল হলো যে, ‘হে রাসূল  ﷺ , মুনাফিকদের কেউ মারা গেলে আপনি তাদের জানাযার নামাজ আদায় করবেন না এমনকি তাদের কবরের পাশেও দাঁড়াবেন না।’

(সূরা: আত -তাওবাহ, আয়াত: ৮৪)

মুনাফিক নামক এই ব্যাধি দূর হলে একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ এবং রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হবে।

পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা থাকবে যেনো তিনি আমাদের সকলকে হেদায়েত করেন এবং মুনাফিকি সকল কাজ থেকে আমাদের হেফাজত করেন।

 
Top