প্রথম অধ্যায় :

1. আক্বিদার পরিচিতি
2. সর্বপ্রথম ঈমানের জ্ঞান অর্জন ফরয
3. আক্বিদা দুরস্ত করা প্রয়োজন কেন?
4. আক্বিদা শুদ্ধ ঈমানদাররাই জান্নাতে যাবে
______________________________________

👉 আকিদা বলতে কী বুঝায়?
__________________________
আক্বিদা'র বাংলা শাব্দিক অর্থ: বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। ভাষাবিদ ইবনে ফারিস (রহ) এই শব্দের অর্থ বর্ণনা করে বলেন, “শব্দটির মূল অর্থই একটিই- দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা । শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহিত । (মু'জামু মাকায়িসিল লুগাহ, ৪/৮৬পৃ.)

তাই বুঝা যায় মানুষ কতিপয় বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণকেই আকিদা বলে। এবার আমরা আক্বিদার পারিভাষিক সংজ্ঞা আলোকপাত করবো।

আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-ফাউমী বলেন,

الْعَقِيْدَةُ مَا يَدِيْنُ الإِنْسَانُ بِهِ وَلَهُ عَقِيْدَةُ حَسَنَةً مِنَ الشَّكِ
-“মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকে ‘আক্বিদা' বলা হয়। যেমন-বলা হয়, তার ভাল আক্বিদা আছে অর্থাৎ তার সন্দেহ মুক্ত দৃঢ় বিশ্বাস আছে।” (আল-মিসবাহুল মুনীর, ২/৪২১পৃ.)।

ড. ইবরাহিম আনীস বলেন,

(العَقِيْدَةُ) الحُكْمَ الَّذِي لَا يَقْبَلُ الشَّكَ فِيهِ لَدَىْ مُعْتَقِدِهِ وَ (فِي الدّين) مَا يُقْصَدُ بِهِ الِاعْتِقَاد دون الْعَمَل كعقيدة وجود الله وَبَعثه الرُّسُل (ج) عَقَائِدْ

-“আক্বিদা অর্থ এমন বিধান বা নির্দেশ যা বিশ্বাসীর বিশ্বাস অনুসারে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ রাখে না....ধর্মীয় বিশ্বাস যা কর্ম থেকে পৃথক । যেমন আল্লাহ তা'য়ালার অস্তিত্ব, রাসূলদের প্রেরণ । এটির বহুবচন আকায়েদ।” (আল-মুজাম আল-ওয়াসীত, ২/৬১৪পৃ.)

👉 সর্বপ্রথম ঈমানের জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয
______________________________________

সর্বপ্রথম ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন। অতঃপর দ্বীনের অন্যান্য জরুরী জ্ঞান শিক্ষা কার ফরয । যেমন :

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَمَّا بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ إِلَى نَحْوِ أَهْلِ اليَمَنِ قَالَ لَهُ: «إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللَّهَ تَعَالَى، فَإِذَا عَرَفُوا ذَلِكَ، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي يَوْمِهِمْ وَلَيْلَتِهِمْ، فَإِذَا صَلَّوْا،

-“রাসূল (ﷺ) যখন মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামান দেশে পাঠান তখন তাঁকে বলেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ যারা কিতাবধারী । সুতরাং তুমি তাদের নিকট পৌছে (সর্বপ্রথম ঈমানের) আহবান করবে, তারা যেন সাক্ষ্য দেয় যে,

আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল । যদি তারা তোমার (ঈমানের) কথা মেনে নেয় (ঈমান গ্রহণ করে) তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও প্রত্যহ দিন-রাত আল্লাহ তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন......।” ১

এ হাদিসে রাসূল (ﷺ) মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) কে সর্বপ্রথম আহলে কিতাবদেরকে ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং ইরশাদ করেছেন যদি আহলে কিতাব তার ঈমানের দাওয়াত কবুল করে, তবে তাদেরকে ইবাদাতের দাওয়াত দিবে নতুবা নয় । সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ঈমানের গুরূত্ব এতই দিতেন যে, তাঁরা ঈমানের হালকা (মজলিস) কায়েম করতেন, পরস্পরে বসে ঈমান শিখতেন এবং অপর জনকে শিখাতেন । যেমন :

হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) আসওয়াদ ইবনে হেলাল (রা) কে লক্ষ্য করে বলেন,

اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً

-“আমাদের সাথে বসুন, কিছুক্ষণ ঈমান শিখি।” ২

আক্বিদা বিশারদ আল্লামা ইবনু আবিল ইয হানাফী (রাঃ) বলেন,


وَلِهَذَا كَانَ الصَّحِيْحُ أَنَّ أَوَّلَ وَاجِبٍ يَجِبُ عَلَى المُكَلَّفِ شَهَادَةُ أَن لا أله الا الله....بَلْ أَئِمَّةُ السَّلَفِ كُلُّهُمْ مُتَّفِقُوْنَ عَلَى أَنَّ أَوَّلَ مَا يُؤْمَنُ بِهِ العَبْدُ الشَّهَادَتَانِ

-“বিশুদ্ধমতে প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর সর্বপ্রথম ঈমান-আকিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয এবং সকল আলেমগণ এ কথায় একমত যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম ঈমান-আক্বিদা বিষয়ক জ্ঞান শিক্ষা করার আদেশ দেওয়া হবে।” (শরহু আক্বিদাতুত তাহাভী )।

👉 আক্বিদা দুরস্ত করা প্রয়োজন কেন?
_________________________________

আক্বিদা শুদ্ধ না হলে তার কোন ইবাদতই আল্লাহ কবুল করা হবে না। হাশরে ময়দানে অসংখ্য ব্যক্তি এমন হবে যে তারা অনেক আমল করেছেন; কিন্তু আক্বিদা শুদ্ধ না থাকার কারণে তাদের আমল আল্লাহ বাতিল বলে ঘোষণা করবেন। যেমন:

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,

وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا

-“(আর) আমি (যখন) তাদের সে সব আমল (ইবাদতের) দিকে মনোনিবেশ করব, যা তারা (দুনিয়াতে) করে এসেছে, তখন আমি তা (তাদের সকল ইবাদত) উড়ন্ত ধুলিকণার মতই (ঈমান শূন্য হওয়ার কারণে) নিষ্ফল করে দিব।” (সূরা ফুরকান, আয়াত, ২৩)

__________________________________

১. ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৯/১১৪পূ, হা/৭৩৭

২. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, হা/১৩২ ২. ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১/১০পৃ.
___________________________________

তাই ঈমান-আক্বিদা যদি শুদ্ধ না থাকেন বান্দার আমল হাশরের ময়দানে ধুলার মতই উড়ে যাবে। তাই এক মাত্র সঠিক দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী না হলে কোন ব্যক্তির আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না ।

হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন,

لَا يَقْبَلُ اللَّهُ لِصَاحِبِ بِدْعَةٍ صَوْمًا، وَلَا صَلَاةً، وَلَا صَدَقَةً، وَلَا حَجًّا، وَلَا عُمْرَةً، وَلَا جِهَادًا، وَلَا صَرْفًا، وَلَا عَدْلًا، يَخْرُجُ مِنَ الْإِسْلَامِ كَمَا تَخْرُجُ الشَّعَرَةُ مِنَ الْعَجِينِ

-“আল্লাহ কোন বিদ'আতীর (তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের বিপরীত কুফুরী-শিরকী আক্বিদা বিশ্বাসে নতুন বিশ্বাসী ব্যক্তির) কোনো রোযা, নামায, সদকা (যাকাত), হজ্জ, ওমরা, জিহাদ, ফরয ইবাদত, নফল ইবাদত কবুল করবেন না । সে (কুফুরী-শিরকী আকিদা পোষণের কারণে) ইসলাম থেকে বাহির হয়ে যাবে, যে ভাবে চুল (সহজে) আটার খমীরা থেকে বাহির হয়ে যায় ।”
(সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/১৯পৃ. হা/৪৯, হাদিসটি হাসান।)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন,

أَبَى اللَّهُ أَنْ يَقْبَلَ عَمَلَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ حَتَّى يَدَعَ بِدْعَتَهُ

-“আল্লাহ বিদআতির (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের বিপরীত দলের অনুসারীর) কোনো ইবাদত কবুল করবেন না, যতক্ষ না সে তার বিদ'আত পরিত্যাগ করে।" (সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/১৯পৃ. হা/৫০, হাদিসটি হাসান পর্যায়ের)

👉 একমাত্র আকিদা শুদ্ধ ঈমানদাররাই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
____________________________________

হাশরের ময়দানে যাদের ঈমান সঠিক বলে বিবেচিত হবে তারাই কেবল জান্নাতে যাবে। তাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য সকলের পূর্বে আক্বিদা শুদ্ধ করা জরুরী। যেমন :

মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا

-“যদি কোন পুরুষ বা মহিলা সৎ কর্ম (ইবাদত) করে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন। (অর্থাৎ ঈমানদার অবস্থায় ইবাদত করে) তাহলে সে (এবং তার মত ঈমানদার লোকেরাই শুধু মাত্র) জান্নাতে প্রবেশ করবে। (ইবাদতের পুরষ্কার দেওয়ার সময়) তাদের উপর বিন্দুমাত্র জুলুম, অবিচার করা হবে না।” (সূরা নিসা, ১২৪)

হযরত উমর (রা.) বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন,

يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، اذْهَبْ فَنَادِ فِي النَّاسِ، أَنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ، قَالَ: فَخَرَجْتُ فَنَادَيْتُ: أَلَا إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ

-“হে খাত্তাবের পুত্র! যাও লোকদের মাঝে ঘোষণা করে দাও যে, একমাত্র ঈমানদাররাই জান্নাতে প্রবেশ করবে । হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি বের হলাম এবং ঘোষণা করলাম: শুনে রাখো, ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহীহ মুসলিম, ১/১০৭, হা/১১৪)

Top