সূরা নাসর
এই সুরাখানিতে রয়েছে মাত্র ৩টি আয়াত। এর অবতরণ স্থল মহাপুণ্যনিকেতন মক্কা নগরী।
আবদুর রাজ্জাক তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে লিখেছেন, মুয়াম্মার সূত্রে জুহুরী বর্ণনা করেছেন, মক্কাবিজয়ের বছর শহরের নিকটে উপস্থিত হয়ে রসুল স. হজরত খালেদের নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক সৈন্যকে পাঠালেন মক্কার ভাটি এলাকায়। সেখানে হজরত খালেদের বাহিনীর সঙ্গে কুরায়েশদের একটি দলের সংঘর্ষ উপস্থিত হলো। বিজয়ী হলেন হজরত খালেদ। এরপর রসুল স. এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিপক্ষীয়দেরকে অস্ত্রসমর্পণের আদেশ দিলেন। সকলেই দলে দলে অস্ত্র সমর্পণ করতে লাগলো এবং গ্রহণ করতে লাগলো ইসলাম। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হলো এই সুরাখানি।
1. যখন আসিবে আল্লাহ্র সাহায্য ও বিজয়
2. এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহ্র দীনে প্রবেশ করিতে দেখিবে
3. তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁহার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করিও এবং তাঁহার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করিও, তিনি তো তওবা কবুলকারী।
প্রথমে বলা হয়েছে ‘ইজা জ্বাআ নাসরুল্লহি ওয়াল্ফাতহ্’। মক্কাবিজয়ের সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়েছিলো বলেই এখানকার ‘ইজা’ (যদি) শব্দটির অর্থ করা হয়েছে ‘ইজ’। এভাবে বক্তব্যটি দাঁড়িয়েছেঃ যখন আসবে আল্লাহ্র সাহায্য ও বিজয়। অন্যান্য আয়াতেও ‘ইজা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘ইজ’ অর্থে। যেমন ‘ইজা জ্বাআ আম্রুনা ওয়া ফারাত তানূর’ (অবশেষে যখন এসে গেলো আমার আদেশ এবং উচছ্বসিত হয়ে উঠলো ভূপৃষ্ঠ), ‘হাত্তা ইজা বালিগা’ (যখন সে পৌঁছলো)।
‘ওয়াল ফাতহ্’ অর্থ বিজয়। অর্থাৎ মক্কাবিজয়। হজরত আবু সাঈদ খুদরী থেকে তিবরানী বর্ণনা করেছেন, মক্কাবিজয়ের দিন রসুল স. বলেছিলেন, এটা সেই দিন, আল্লাহ্ যে দিনের প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি স. আবৃত্তি করলেন ‘ ইজা জ্বাআ নাসরুল্লহি ওয়াল ফাতহ্’।
ঐতিহাসিকেরা ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ হুদায়বিয়া নামক স্থানে রসুল স. কুরায়েশদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য একটি অনাক্রমণ চুক্তি করলেন, যার শর্তগুলোর মধ্যে ছিলোঃ এই দশ বৎসর জনগণকে দেওয়া হবে পূর্ণনিরাপত্তা। তারা অবাধে চলাচল করতে পারবে। অন্যান্য গোত্র তাদের ইচ্ছামতো যে কোনো দলে যোগদান করতে পারবে। এই শর্তটির কারণে আরবের বিভিন্ন গোত্র তাদের ইচ্ছামতো যোগ দিতে লাগলো মুসলমান অথবা কাফের কুরায়েশদের সঙ্গে। মুসলিম দলে যোগ দিলো খাজাআ গোত্র এবং বনী বকর যোগ দিলো কুরায়েশদের সঙ্গে। গোত্রদুটির মধ্যে ছিলো দীর্ঘদিনের প্রলম্বিত বিদ্বেষ। কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর বনী বকর চড়াও হলো বনী খাজাআদের উপর। কুরায়েশদের মধ্য থেকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলো সাফোয়ান ইবনে উমাইয়া, ইকরামা ইবনে আবু জেহেল, সুহাইল ইবনে আমর। শায়বা ইবনে ওসমান, হুয়াইতাব ইবনে আবদুল উজ্জা এবং তাদের সঙ্গী সাথীরা। প্রচণ্ড লড়াই হলো। দু’পক্ষেই হতাহত হলো অনেক লোক। যুদ্ধশেষে কুরায়েশেরা বুঝতে পারলো, রসুল স. এর সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করা হয়েছে। এর জন্য তারা পরস্পরকে দোষারোপ করতে শুরু করলো। আমর ইবনে সালেম খাজায়ী তার গোত্রের চল্লিশ জনকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ জানানোর অভিপ্রায়ে যাত্রা করলো মদীনা অভিমুখে। কিন্তু তারা মদীনায় উপস্থিত হওয়ার আগেই রসুল স. ঘটনাটি জেনে ফেললেন। সাহাবীগণকে বললেন, কুরায়েশরা চুক্তিভঙ্গ করেছে। অবশ্য এটাই ছিলো আল্লাহ্র অভিপ্রায়। জননী আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ রয়েছে? তিনি স. বললেন, হ্যাঁ। জননী আয়েশা থেকে মোহাম্মদ ইবনে আমর এবং জননী উম্মে সালমা থেকে তিবরানীও এরকম বর্ণনা করেছেন।
আমর ইবনে সালেম খাজায়ী তার লোকজনকে নিয়ে মদীনায় পৌঁছলো। রসুল স.কে খুলে বললো সকল বৃত্তান্ত। রসুল স. বললেন, এখন তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা আমার কর্তব্য। নতুবা আমরাও তো তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারবো না। ঘটনাটি ঘটেছিলো হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির বাইশ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর শাবান মাসে। রসুল স. তিনটি শর্ত জানিয়ে তাঁর প্রতিনিধিরূপে মক্কায় পাঠালেন হজরত হামযাকে। শর্ত তিনটি ছিলোঃ ১. বনী খাজাআর নিহত ১৩ জনের জন্য রক্তপণ দিতে হবে ২. অন্যথায় বনী খাজআকে আক্রমণকারী বনী বকরের মিত্রশক্তি বনী নাফাছাকে করে দিতে হবে চুক্তিবহির্ভূত, যেনো মুসলমানগণ তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারে ৩. অথবা রহিত করে দিতে হবে হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি। শর্ত তিনটির কথা জেনে কুরায়েশরা মহা বিপদে পড়লো। নিজেদের মধ্যে তুমুল তর্কবির্তকের পর একমত হলো যে, সন্ধিচুক্তি রহিত করে দেওয়াই উত্তম। হজরত হামযা সন্ধিচুক্তি বাতিলের সংবাদ নিয়ে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
রসুল স. পরামর্শ সভায় বসলেন। হজরত আবু বকর পরামর্শ দিলেন, হে আল্লাহ্র প্রিয়তম রসুল! তাদের প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শন করাই উত্তম। সন্ধিচুক্তিটি পুনর্বহাল করলেই মনে হয় ভালো হয়। কেননা তারা তো আপনারই স্বজাতি। অচিরেই হয়তোবা তারা আপনার অনুগামীও হয়ে যেতে পারে। হজরত ওমর বললেন, যুদ্ধ, কেবল যুদ্ধই হচ্ছে এর একমাত্র সমাধান। হে আল্লাহ্র প্রিয়তম বাণীবাহক! আপনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুন। তারা তো সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যেও নিকৃষ্ট সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী। তারা আপনাকে ‘পাগল’ ‘যাদুকর’ কতো কিছু বলে অপবাদ দেয়। সুতরাং যুদ্ধের মাধ্যমেই তাদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। তাদেরকে পরাভূত করতে পারলে সমগ্র আরব আপনার করতলগত হবে। আর অনুগামী যদি হয়, তবে সমগ্র আরব হবে আপনার অনুগত।
রসুল স. হজরত ওমরের অভিমতকেই গ্রহণ করলেন। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলেন নীরবে। আরবের বিভিন্ন গোত্র-শাখাগোত্রকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন কুরায়েশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে। ফলে আসলাম, গিফার, মুজাইনা, হরফিয়া, আশজা ও সুলাইম গোত্রের লোকেরা যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়েসমবেত হলো মদীনায়। অন্যান্য গোত্রগুলো সংবাদ পাঠালো, তারা পথে তাদের লোকজন নিয়ে মিলিত হবে। এভাবে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ালো দশ হাজার, মতান্তরে বারো হাজারে। সম্ভবত মদীনা থেকে যাত্রার প্রাক্কালে সৈন্যসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। পথে অন্যান্যরা যোগ দিলে সে সংখ্যা হয়ে যায় বারো হাজার।
ওদিকে কুরায়েশরা চিন্তিত হয়ে পড়লো। মদীনায় পাঠালো তাদের প্রিয় নেতা আবু সুফিয়ানকে। তিনি মদীনায় এসে সোজাসুজি উপস্থিত হলেন তাঁর কন্যা উম্মতজননী উম্মে হাবীবার গৃহে। রসুল স. এর শয্যায় উপবেশনের উদ্যোগ করতেই জননী উম্মে হাবীবা বিছানা গুটিয়ে নিলেন। বললেন, এটা রসুলুল্লাহ্ স. এর বিছানা। এর উপরে কোনো মুশরিক উপবেশন করতে পারে না। আবু সুফিয়ান বললেন, তুমি আমার কন্যা হয়ে আমার সঙ্গে এরকম আচরণ করতে পারলে? জননী উম্মে হাবীবা বললেন, হ্যাঁ, আমি আপনার কন্যা, কিন্তু আল্লাহ্ তো দয়া করে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন পবিত্র ইসলামের ছায়ায়। অথচ আপনি একজন গোত্রপতি হলেও এখনো অংশীবাদী। আপনার তো উচিত এই মুহূর্তে মহাসত্য ইসলামকে গ্রহণ করা।
আবু সুফিয়ান সেখানে আর দাঁড়ালেন না। বাইরে এসে সাক্ষাত করলেন রসুল স. এর সঙ্গে। তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন অনেক কথা। রসুল স. তার একটিরও জবাব দিলেন না। তিনি তখন সুপারিশকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন হজরত আবু বকরকে। তিনি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। সরাসরি বলে দিলেন, আপনার জন্য আমি কোনো সুপারিশ করতে পারি না। হজরত ওমর রাগান্বিত হলেন। তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, যুদ্ধই সকল সমস্যার সমাধান। আমার কাছে যদি মাত্র একটি ছড়িও থাকে, তবুও তো আমি তাই নিয়ে যুদ্ধ করবো আপনাদের বিরুদ্ধে। আবু সুফিয়ান এবার দেখা করলেন হজরত আলী ও হজরত ফাতেমার সঙ্গে। তাঁরাও তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। শেষে বিফল মনোরথ হয়ে তিনি ফিরে গেলেন মক্কায়। কিছুকাল পরে হজরত ইবনে উম্মে মকতুম, অথবা হজরত আবু জর গিফারীকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে রসুল স. ৮ম হিজরী সনের ১০ই রমজানে সদলবলে যাত্রা করলেন মক্কা অভিমুখে। দোয়া করলেন, হে আমাদের প্রভুপালক! গুপ্তচরের অপপ্রভাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা কোরো।
বোখারীর বর্ণনায় এসেছে, হজরত আলী বলেছেন, রসুল স. যোবায়ের, মেকদাদ ও আমাকে আদেশ করলেন, এক্ষুণি মক্কার দিকে যাত্রা করো। বুস্তানখাখে পৌঁছে এক উষ্ট্রারোহিনীর সাক্ষাত পাবে। তার কাছে একটি পত্র আছে, পত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে এসো। আমরা যাত্রা করলাম। বুস্তানখাখে পৌঁছে দেখা পেলাম কথিত উষ্ট্রারোহিনীর। তার গতিরোধ করে বললাম, চিঠিটা দাও। সে বললো, আমার কাছে কোনো চিঠি নেই। আমি বললাম, ভালোয় ভালোয় বের করে দাও। নয়তো তোমাকে বিবস্ত্র করে তল্লাশী করা হবে। সে এবার বিনা বাক্যে বের করে দিলো চিঠিটি। আমরা চিঠি নিয়ে ফিরে এলাম মদীনায়। চিঠিটি লিখেছিলেন হাতেব ইবনে আবী বালতা। ওই চিঠির মাধ্যমে তিনি মক্কায় অবস্থানরত তাঁর আত্মীয়স্বজনদেরকে রসুল স. এর মক্কা অভিযানের সংবাদ জানিয়ে দিয়েছিলেন। রসুল স. তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, হাতেব! কী ব্যাপার? হাতেব বললেন, আমি মার্জনাপ্রার্থী। তবে হে আল্লাহ্র প্রিয়তম রসুল! এর মধ্যে আমার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো না। আমার পরিবার-পরিজন রয়েছে মক্কায়। আমার কিছুসংখ্যক মুহাজির ভাইদের স্বজন-পরিজনও রয়েছে সেখানে। চিঠির মাধ্যমে আমি কেবল তাদের নিরাপত্তা কামনা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এই সংবাদ পাওয়ার কারণে তারা হয়তো কুরায়েশদের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। বিজয় তো হবে আপনারই। রসুল স. বললেন, হাতেব সত্য কথাই বলেছে। হজরত ওমর বললেন, হে আল্লাহ্র রসুল! তার আচরণ তো মুনাফিকদের মতো। অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। রসুল স. বললেন, রসনা সংযত করো। তুমি কি জানো না হাতেব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন গাজী। ওই যুদ্ধবিজয়ীদের সম্পর্কে কি আল্লাহ্ এই বলে শুভসমাচার দান করেননি যে ‘তোমাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছে। এখন তোমরা যা খুশী তাই করতে পারো’। হজরত ওমর অনুতপ্ত হলেন। প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হলো। ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে বরণ কোরো না’।
এরপর রসুল স. কাবাগৃহের চাবি সংগ্রহের জন্য হজরত বেলালকে পাঠিয়ে দিলেন চাবিরক্ষক ওসমানের কাছে।ওসমান বললো, চাবি তো আমার মায়ের কাছে। একথা বলেই সে তার মায়ের কাছে চাবি চাইলো। তার মা বললো, লাত ও উজ্জার শপথ! আমি কাবার চাবি তোমার হাতে কখনোই দিবো না। সে বললো, মা! চাবিটা দিয়ে দাও। আজ লাত উজ্জা কেউ নেই। চাবি না দিলে আমার গর্দান তো যাবেই, আমার এই ভাইয়ের গর্দানও আস্ত থাকবে না। ওদিকে তাঁদের ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে রসুল স. সেখানে পাঠিয়ে দিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দীক এবং হজরত ওমর ফারুককে। তাঁরা ওসমানের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকলেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনে তার মা বললো, ওসমান! এই নাও চাবি।ওদের হাতে চাবি দেওয়ার চেয়ে তোমার হাতে দেওয়াই ভালো। এভাবে চাবি উদ্ধার হলো এবং তা যথাসময়ে হস্তগত হলো রসুল স. এর। তিনি স. ওই চাবি দিয়ে কাবাগৃহের বন্ধ তালা খুললেন। ওসমান ও তালহা বললো, হে আল্লাহ্র রসুল! এ অধিকার তো ছিলো আমাদেরই। তিনি স. তাদের কথায় ভ্রূক্ষেপ করলেন না।
রসুল স. রোজাদার ছিলেন। রোজা রেখেছিলেন সাহাবীগণও। সকলে ইফতার করলেন কাদীর নামক স্থানে পৌঁছে।
রসুল স.এর প্রিয় পিতৃব্য হজরত আব্বাস ছিলেন হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্বে। তিনি ওই সময় বেরিয়ে পড়েছিলেন মক্কা থেকে। উদ্দেশ্য ছিলো হিজরত। সৌভাগ্যবশত তিনি রসুল স. এর সাক্ষাত পেলেন জুহফা নামক স্থানে। তাঁর চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেছ এবং তাঁর পুত্র জাফর ইবনে আবু সুফিয়ান রসুল স. এর সঙ্গে মিলিত হলেন আবওয়ায়। তাঁরাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, আবু সুফিয়ান এবং আতেকার পুত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে উমাইয়া আবওয়া নামক স্থানে রসুল স. এর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন। তিনি স. তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ওদের কোনো প্রয়োজন আমার নেই। ওরা আমার সম্পর্কে অনেক অবান্তর কথা বলেছে। আমার মর্যাদাহানি করেছে। তাঁরা শরণ গ্রহণ করলেন উম্মতজননী উম্মে সালমার। জননী তাঁদের পক্ষে সুপারিশ করলেন। রসুল স. আর তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করলেন না।
কাদীরে পৌঁছেই যুদ্ধের পতাকা উড্ডীন করবার আদেশ দিলেন রসুল স.। পতাকা ভাগ করে দিলেন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে। তাঁর ব্যক্তিগত দলের পতাকাবাহী হলেন হজরত যোবায়ের। এরপর যাত্রা শুরু করলেন। ইশার নামাজের সময় পৌঁছে গেলেন মাররুজ জাহরান নামক স্থানে। তখন পর্যন্ত কুরায়েশরা রসুল স. এর অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। ওই রাতেই আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হাযাম এবং বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা গোপনে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মক্কা থেকে বের হলো। রসুল স. তাঁর সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করার আদেশ দিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হলো। এক সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলো প্রায় দশ হাজার স্থানে। হজরত আব্বাস আপন মনে বলে উঠলেন, এই রাত্রিশেষের ভোর হবে কুরায়েশদের জন্য অত্যন্ত অশুভ। আল্লাহ্র শপথ! আজ যদি মোহাম্মদ মহাপ্রতাপের সঙ্গে মক্কায় প্রবেশ করে, তবে কুরায়েশদের দাপট নিভে যাবে চিরতরে। এরপর তিনি একটি খচ্চরের পিঠে চড়ে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলেন এই উদ্দেশ্যে যে, যদি মক্কার দিকে গমনকারী কোনো জ্বালানী সংগ্রহকারী, দুগ্ধ বিতরণকারী, অথবা অন্য কোনো পথিকের মাধ্যমে কুরায়েশদেরকে এই সংবাদটি পৌঁছে দেওয়া যায় যে, বাঁচতে যদি চাও, তবে আল্লাহ্র রসুলের নিকট উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তাপ্রার্থী হও। কিছুদূর অগ্রসর হতেই তিনি আবু সুফিয়ানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তিনি বলছিলেন, আল্লাহ্র শপথ! আজ রাতের মতো আলোর মেলা আমি জীবনে দেখিনি। হজরত আব্বাস তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, শোনো আবু সুফিয়ান! মোহাম্মদ তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছেন। তাঁকে প্রতিহত করা অসম্ভব। আবু সুফিয়ান বললেন, তাহলে উপায়? হজরত আব্বাস বললেন, তুমি যদি ধরা পড়ো, তবে নিশ্চয় তোমার মস্তক ছেদন করা হবে। তার চেয়ে আমার বাহনে উঠে পড়ো। আমি তোমাকে তাঁর কাছে পৌঁছে দেই। তুমি তাঁর কাছে নিরাপত্তা ভিক্ষা করো। আবু সুফিয়ান তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হলেন। রসুল স. এর কাছে পৌঁছার আগেই তাঁরা ধরে পড়ে গেলেন হজরত ওমরের চোখে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আরে, আরে, এতো দেখছি আল্লাহ্র দুশমন। বিনা চেষ্টায় এসে গ্যাছে আমাদের দখলে। একথা বলেই তিনি আবু সুফিয়ানকে আঘাত করার জন্য ছুটে এলেন। তার আগেই হজরত আব্বাস তাঁকে নিয়ে দ্রুত উপস্থিত হলেন রসুল স. সকাশে। রসুল স. তাঁর কথা শুনে বললেন, আজ রাতের জন্য আপনি তাঁকে আপনার সঙ্গেই রাখুন।
সকাল হলো। হজরত আব্বাস আবু সুফিয়ানকে নিয়ে উপস্থিত হলেন রসুল স. এর মহান সান্নিধ্যে। রসুল স. বললেন, হে কুরায়েশ গোত্রপতি! এখনো কি লা ইলাহা ইল্লাল্লহ্ মোহাম্মাদুর রসুলুল্লহ্ কলেমায় বিশ্বাসী হবার সময় আসেনি? আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পিতামাতা আপনার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হোক। আপনি সহিষ্ণু, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী। আল্লাহ্র শপথ! আমার ধারণা, দ্বিতীয় কোনো আল্লাহ্র অস্তিত্ব যদি থাকতো, তবে তুমিই হতে সেই আল্লাহ্। রসুল স. বললেন, আমি যে আল্লাহ্র রসুল, এ বিষয়ে তোমার হৃদয়ে এখনো কি প্রতীতি জন্মেনি? আবু সুফিয়ান বললো, না। এখনো আমার মনে রয়ে গেছে কিছুটা খটকা। হজরত আব্বাস বললেন, আরে অবুঝ! ইসলাম গ্রহণ করো। মস্তক ছেদিত হওয়ার আগেই বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লহ্ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লহ্। আবু সুফিয়ান আর কথা বাড়ালেন না। পবিত্র কলেমা উচ্চারণ করলেন উদাত্ত কণ্ঠে। হজরত বুদাইল ও হাকীম তো ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এর আগেই।
তিবরানী লিখেছেন, রসুল স. তখন বলেছিলেন, হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! আবু সুফিয়ান ওই পিলু গাছের আড়ালেই আছে। তাকে বন্দী করে আনো। ইবনে আবী শায়বা বর্ণনা করেছেন, আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীদেরকে বন্দী করেছিলেন রসুল স. এর দেহরক্ষীগণ। আর সেদিন তাঁর দেহরক্ষীগণের প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন হজরত ওমর। তাঁর বর্ণনায় আরো এসেছে, আবু সুফিয়ান তখন বলেছিলেন, আব্বাস কোথায়? আর এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, আবু সুফিয়ানকে যখন রসুল স. এর কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তখন তাঁর সাথে হজরত আব্বাসও ছিলেন। রসুল স. তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ওই ব্যক্তিদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া হলো, যারা আশ্রয় গ্রহণ করবে কাবাপ্রাঙ্গণে, আবু সুফিয়ানের গৃহে, অথবা নিজ নিজ বাড়িতে। আবু সুফিয়ান মক্কায় পৌঁছে ঘোষণা করেছিলেন, হে কুরায়েশ জনতা! আজ মোহাম্মদ এমন একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আগমন করেছেন, যার অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার সাধ্য তোমাদের নেই। সুতরাং তোমরা তাঁর ঘোষিত নিরাপত্তা গ্রহণ করো। আশ্রয় নাও কাবাপ্রাঙ্গণে, আমার বাড়িতে, অথবা নিজ নিজ ঘরে। লোকজন সেরকমই করলো।
হাকীম ইবনে হাযাম এবং বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা রসুল স. এর পবিত্র হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করলেন। রসুল স. তাঁদেরকে আহবায়করূপে প্রেরণ করলেন কুরায়েশদের কাছে। তাঁরা মক্কায় উপনীত হলেন। এরপর তিনি স. মুহাজির ও আনসার বাহিনীর সৈনাপত্যের দায়িত্ব দিলেন হজরত যোবায়েরকে। নির্দেশ দিলেন, মক্কার উজানে হাজ্জন নামক স্থানে পৌঁছে পতাকা উত্তোলন কোরো। পুনরাদেশপ্রাপ্তির পূর্বে স্থানত্যাগ কোরো না। তিনি পতাকা হাতে অগ্রসর হলেন। ওই হাজ্জন এলাকা দিয়েই রসুল স. মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে তাঁর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিলো তাঁবু। তিনি স. তখন হজরত খালেদ ইবনে ওলীদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তুমি বনী খাজাআ ও বনী সুলাইমকে নিয়ে প্রবেশ কোরো মক্কার ভাটি এলাকা দিয়ে। কুরায়েশ এবং আবদে মানাফের বংশদ্ভূতরা ইতোপূর্বে বনী বকরকে ভাটি অঞ্চলের দিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেজন্যই রসুল স. হজরত খালেদকে ভাটির দিক থেকে অগ্রাভিযান শুরু করতে বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন, যদি তোমাদের বিরুদ্ধে কেউ লড়তে না আসে, তবে তোমরাও লড়াই কোরো না।
রসুল স. তখন হজরত সা’দ ইবনে উবাদার হাতেও নিশান তুলে দিয়েছিলেন। তিনি স. কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন কাদার পথ দিয়ে। প্রবেশ কালে জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আজ লড়াইয়ের দিন। আজ নিষিদ্ধতা বৈধ (আজ রক্তপাতের নিষিদ্ধতা স্থগিত)। জনৈক মুহাজির একথা শুনে বললেন, হে আল্লাহ্র রসুল! শুনুন, সা’দ কী বলছে? সে তো কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে এরকম বলতে পারে না। রসুল স. তখন হজরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঠিক আছে। পতাকা উত্তোলন করো তুমি। অগ্রসর হও কাদার পথ দিয়ে। হজরত আলী তাই করলেন। তারপর তাঁর পতাকা উড্ডীন করলেন কাবাপ্রাঙ্গণের রুকনে ইয়েমেনে।
আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন, হজরত যোবায়ের বর্ণনা করেন, রসুল স. তখন ঝাণ্ডা তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে। আর তিনি স. মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন দু’টি ঝাণ্ডা নিয়ে। আলী আমার আগে মক্কার চড়াই অঞ্চলে পৌঁছুতে পারেননি। আর নিম্নাঞ্চল দিয়ে প্রবেশকালে খালেদ সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতার। কুরায়েশ ও অন্যান্য অংশীবাদী গোত্রের লোকেরা তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তিনিও তাদের উপরে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন বীর বিক্রমে। ওই সংঘর্ষে নিহত হয় কুরায়েশদের চব্বিশ জন এবং হুজাইল গোত্রের চার জন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, ওই সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলো বারো অথবা তেরো জন। এর পরেই অংশীবাদীরা পরাভব স্বীকার করে। কেউ কেউ পালিয়ে যায়। তখন মুসলমানদের মধ্যে শহীদ হয়েছিলেন জুহাইনা গোত্রের হজরত সালমা ইবনে খাইলা, হজরত ইবনে জাবের ফেহরী এবং হজরত হারীশ ইবনে খালেদ। অবশ্য রসুল স. তাঁর সকল সেনানায়ককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মক্কায় প্রবেশকালে কাউকে হত্যা করা যাবে না। তবে কেউ আক্রমণ করলে কেবল তাকে হত্যা করা যাবে। আবার তিনি স. নির্দিষ্ট করে কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ওদেরকে কোনোক্রমে রেহাই দেওয়া যাবে না, তারা যদি কাবাগৃহের গেলাফের নিচেও আশ্রয় নেয়, তবুও। তাদের নামঃ ১. আবদুল্লাহ্ ইবনে আবী সাররাহ্। সে মুসলমান হওয়ার পরে ধর্মত্যাগ করেছিলো। মক্কাবিজয়ের দিবসে হজরত ওসমানের সুপারিশে তাকে রেহাই দেওয়া হয়। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ২. ইকরামা ইবনে আবু জেহেল। মক্কাবিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ৩. হুয়াইরিছ ইবনে নকীদ। হিজরতের পূর্বে সে মুসলমানদেরকে খুবই কষ্ট দিয়েছিলো। তাকে হত্যা করেছিলেন হজরত আলী। ৪. হাকীম ইবনে সাবাবা। সে মুসলমানও হয়েছিলো। জি-কারার যুদ্ধে জনৈক আনসারী ভুলক্রমে শত্রুসেনা মনে করে হত্যা করেছিলেন তার ভাইকে। ওই মান্যবর আনসারী থেকে সে রক্তপণ আদায় করেছিলো। তারপর সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে তাঁকেই আবার হত্যা করে সে ধর্মত্যাগী হয়ে যায়। তাকে হত্যা করে তার নিজের সম্প্রদায়ের গাইলা ইবনে আবদুল্লাহ্। ৫. হুব্বার ইবনে আসওয়াদ, খুবই নিষ্ঠুর চরিত্রের লোক ছিলো সে। মুসলমানদেরকে সে অত্যাচারে অত্যাচারে অতিষ্ঠ করে তুলতো। রসুল স. এর প্রিয় পুত্রী হজরত জয়নাবকে সে এমন আঘাত করেছিলো যে, এতে তাঁর গর্ভপাত ঘটে। ওই আঘাতজনিত রোগেই তিনি পরলোকগমন করেন। মক্কারবিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রসুল স. তাঁকে মার্জনা করেন। ৬. হারেছ ইবনে তিল্লাল খাজায়ী। তাকে হত্যা করেছিলেন হজরত আলী। ৭. কবি কা’ব ইবনে জুহাইর। সে রসুল স.কে অপবাদ দিয়ে কবিতা রচনা করতো। মক্কাবিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রসুল স. এর প্রশংসায় রচনা করেন অনবদ্য কবিতা। ৮. ওয়াহশী ইবনে হারব। তিনি ছিলেন রসুল স. এর প্রিয় খুল্লতাত শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযার হত্যাকারী। মক্কাবিজয়ের দিন তিনি তায়েফে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তায়েফ থেকে ফিরে আসেন এবং আশ্রয় গ্রহণ করেন ইসলামের চিরনিরাপত্তা ও শান্তির ছায়ায়। ৯. আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযাল। প্রথমে তার নাম ছিলো আবদুল উজ্জা। ইসলাম গ্রহণের পর রসুল স. তাঁর নাম রাখেন আবদুল্লাহ্। একবার রসুল স. তাকে জাকাত সংগ্রাহকরূপে এক স্থানে পাঠালেন। সহযোগীরূপে সঙ্গে দিলেন হজরত আবদুল্লাহ্ খাজায়ীকে। তিনি ছিলেন পাচক। পথিমধ্যে উভয়ে এক সরাইখানায় যাত্রাবিরতি করলেন। একদিন দুপুর বেলা জাকাতসংগ্রাহক আবদুল্লাহ্ পাচক হজরত আবদুল্লাহ্কে বললো একটা কিছু জবাই করে তার গোশত রান্না করো। কিন্তু পাচক হজরত আবদুল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ পালনে আলস্য করলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে সে তাঁকে হত্যা করলো। আর পালিয়ে গেলো ধর্মত্যাগী হয়ে। তার সঙ্গে থাকতো দু’জন নৃত্যগীতপটিয়সী ক্রীতদাসী। তারা তাদের গানের মাধ্যমে রসুল স. এর কুৎসা রটনা করতো। মক্কাবিজয়ের দিবসে রসুল স. মুরতাদ আবদুল্লাহ্ এবং ওই ক্রীতদাসীদ্বয়কে হত্যার নির্দেশ দেন। হজরত সাঈদ ইবনে হারেছ মাখজুমী ও হজরত আবু বারযাহ্ আসলামী ওই মুরতাদ ও তার একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করতে সমর্থ হন। অপর ক্রীতদাসী যায় পালিয়ে। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে। ১০. আমর ইবনে হাশেমের মুক্তকৃতা ক্রীতদাসী সারা। সে ছিলো মক্কার প্রসিদ্ধ গায়িকা। তার কাছ থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিলো হজরত হাতেব ইবনে আবী বালতার চিঠি। মক্কাবিজয়ের পর সে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো। ১১. হজরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। সে উহুদ যুদ্ধে চর্বণ করেছিলো রসুল স. এর প্রিয় পিতৃব্য শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযার কলিজা। রসুল স. তাঁকে মার্জনা করেছিলেন। ১২. সাফওয়ান ইবনে উমায়ইয়া। মক্কাবিজয়ের দিন সে জেদ্দায় পালিয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো, সে হয়তো সেখান থেকে কোনো জাহাজযোগে ইয়েমেনের দিকে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করতে সক্ষম হবে। রসুল স. তাকে নিরাপত্তা দেন হজরত উমাইর ইবনে ওয়াহাবের সুপারিশে। তাই সে জেদ্দা থেকে ফিরে আসে এবং ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে চিন্তাভাবনার জন্য অবকাশ প্রার্থনা করে দুই মাসের। রসুল স. তাকে চার মাসের অবকাশ দেন। পরে তিনি মুসলমান হয়ে যান।
ইমাম আহমদ ও তিরমিজির বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. মক্কায় প্রবেশ করেন পাগড়ীপরিহিত অবস্থায়। বোখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, তখন তাঁর পবিত্র মস্তকে শোভা পাচ্ছিলো শিরোস্ত্রাণ। পরে পাগড়ী। প্রবেশকালে তিনি স. বার বার আবৃত্তি করেন সুরা নাসর। পরিশেষে রসুল স. হাজ্জন নামক স্থানে তাঁর জন্য নির্মিত তাঁবুতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই মহাপুণ্যবতী সহধর্মিণীঃ হজরত উম্মে সালমা ও হজরত মায়মুনা। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে মহাবিজয়ী! আপনি কি আপনার পৈত্রিক নিবাসে উঠবেন না? তিনি স. বললেন, আকীল কি সে সুযোগ রেখেছে? কোথায় গিয়ে উঠবো? উল্লেখ্য, আকীল রসুল স. এর পিতৃপুরুষদের বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়েছিলো। জনৈক সাহাবী বললেন, হে মহাবাণীবাহক! সেখানে তো অনেকেরই বাড়িঘর রয়েছে। আপনি তো যে কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারেন। তিনি স. বললেন, না। আমি কারো বাড়িতেই উঠবো না। তাই হলো। রসুল স. তাঁর তাঁবুতেই অবস্থান করতে লাগলেন। নামাজের সময় সেখান থেকেই তিনি স. উপস্থিত হতেন কাবা গৃহে। প্রথম দিন তিনি স. তাঁর তাঁবুতে কিছুক্ষণ বিশ্রামগ্রহণের পর স্নান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পানি সংগ্রহ করা হলো। তাঁর প্রিয় পুত্রী হজরত ফাতেমা পর্দার ব্যবস্থা করলেন। স্নান সমাপনের পর তিনি স. পাঠ করলেন আট রাকাত চাশতের নামাজ। মুসলিম।
বোখারীর বর্ণনায় এসেছে, তাঁর চাচাতো বোন হজরত উম্মে হানী বলেছেন, তিনি স. সেদিন স্নান করেছিলেন আমার গৃহে এসে। এরপর নামাজ পাঠ করে তিনি স. উটের পিঠে চড়ে গমন করেন কাবাপ্রাঙ্গণে এবং উষ্ট্রারোহী অবস্থাতেই যষ্টি দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুম্বন দান করেন। উচ্চারণ করেন তকবীরধ্বনি। সাথে সাথে তার প্রতিধ্বনি ওঠে তাঁর সহচরবর্গের কণ্ঠে। তিনি স. সাতবার কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করেন। প্রদক্ষিণ করেন তাঁর সহচরবৃন্দও। প্রতিবারেই তিনি স. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন তাঁর যষ্টি দ্বারা। কাবাপ্রাঙ্গণে তখন প্রতিষ্ঠিত ছিলো ক্ষুদ্র-বৃহৎ তিন শত ষাটটি প্রতিমা। তিনি সেগুলোকে আঘাত করেন যষ্টি দ্বারা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমাগুলো হয়ে পড়ে ছিন্ন-ভিন্ন এবং ভূতলশায়ী। তাঁর পবিত্র কণ্ঠে তখন বার বার উচ্চারিত হতে থাকে ‘জ্বাআল হাক্বক্বু ওয়া যাহাক্বাল বাতিল’ (সত্য সমাগত, মিথ্যা তিরোহিত)। রসুল স. এর যষ্টির আঘাত ছাড়াই তখন অনেক প্রতিমা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। ফুজালা ইবনে ওমর লাইছি মনে মনে ইচ্ছা করে, তাওয়াফরত অবস্থাতেই সে রসুল স.কে হত্যা করবে। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলো তাঁর কাছে। তিনি স. ডাকলেন, ফুজালা! সে জবাব দিলো, এই যে আমি। তিনি স. জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মন কী বলছে? সে বললো, তেমন কিছু না। আমি তো আল্লাহ্র নাম স্মরণ করছি। তার কথায় রসুল স. মৃদু হাসলেন। বললেন, লজ্জিত হও। আল্লাহ্র কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো। তিনি স. ফুজালাকে আরো কাছে ডেকে এনে তাঁর পবিত্র হস্ত স্থাপন করলেন তাঁর বক্ষদেশে। পরে হজরত ফুজালা নিজেই বর্ণনা করেছেন, রসুল স. তাঁর পবিত্র হস্ত আমার উপর থেকে উঠিয়ে নেওয়ার আগেই আমি গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে অনুভব করলাম, এখন তিনি স.ই আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম জন। অংশীবাদীরা পর্বত শিখর থেকে এসবকিছুই চাক্ষুষ করেছিলো।
তাওয়াফ পর্ব সমাপ্ত হলো। চতুষ্পার্শ্বে তখনও প্রচণ্ড ভীড়। রসুল স. তাঁর উট থেকে অবতরণ করলেন। উটটিকে কোথাও বসানোর স্থান পাওয়া গেলো না। তাই সেটিকে রেখে আসা হলো কাবা চত্বরের সীমানার বাইরে। রসুল স. মাকামে ইব্রাহিমে উপস্থিত হলেন। তখন তার মাথায় ছিলো উষ্ণীষ। তিনি স. সেখানে দুই রাকাত নামাজ পাঠ করলেন। গেলেন জমজম কূপের পাশে। কূপের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, যদি আবদুল মুত্তালিবের গোষ্ঠীর জন্য এটা গর্বের বিষয় না হতো, তবে আমি আজ নিজ হাতে এক ডোল পানি উত্তোলন করতাম। এক ডোল পানি উত্তোলন করলেন হজরত আব্বাস, অথবা হারেছ ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রসুল স. পান করলেন পবিত্র জমজমের জল। বাদবাকীটুকু দিয়ে সামাধা করলেন ওজু। ওজুর ব্যবহৃত জলাহরণের জন্য সাহাবীগণের মধ্যে লেগে গেলো ঠেলাঠেলি, প্রতিযোগিতা। যারা সে জলের অংশ পেলেন, তারা তা সঙ্গে সঙ্গে মেখে নিলেন নিজেদের মাথায়, চোখে-মুখে-শরীরে। কুরায়েশেরা এমতো অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলো। বলতে লাগলো, আমরা কোনো রাজাকেও এরকম সম্মান পেতে দেখিনি। শুনিওনি। হোবল ছিলো পৌত্তলিকদের সর্ববৃহৎ প্রতিমা। প্রতিমাটি ছিলো কাবাগৃহের সামনের দিকে প্রধান ফটকের কাছে। রসুল স. এর নির্দেশে সেটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হলো।
হজরত আলী বর্ণনা করেছেন, রসুল স. কাবাগৃহের ছাদে উঠলেন। আমাকেও বললেন, ওঠো। উঠলাম। ছাদের উপরে ছিলো আর একটি বড় প্রতিমা। আমি সেটিকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিচে ফেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো প্রতিমাটি। রসুল স. উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলন ‘সত্য সমাগত, অসত্য তিরোহিত। অসত্যের তিরোহিতি তো অবধারিত’।
এরপর রসুল স. হজরত ওমরকে আদেশ করলেন,কাবাগৃহের ভিতর থেকে সমস্ত বিগ্রহ ও চিত্র অপসারিত করো। নির্দেশ প্রতিপালিত হলো। শুরু হলো ধোয়া-মোছার কাজ। এভাবে একসময় আল্লাহ্র ঘর ও তৎসন্নিহিত প্রাঙ্গণ থেকে চিরতরে অপসারিত হলো বিগ্রহ-ধর্ম-সংস্কৃতির অপবিত্র চিহ্নাবলী। রসুল স. হজরত জায়েদ এবং হজরত তালহাকে নিয়ে কাবাগৃহের ভিতরে প্রবেশ করলেন। মধ্যখানে দাঁড়িয়ে পাঠ করলেন দুই রাকাত নামাজ। বললেন, এটাই কেবলা। তারপর দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।বললেন, আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি তাঁর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিকে সত্যে পরিণত করেছেন। তাঁর বান্দাকে বিজয়ী করেছেন তাঁর প্রতিপক্ষীয়দের উপর।শোনো হে জনতা! আজ থেকে মূর্খতার যুগের সকল অপপ্রথা অবলোপিত হলো। পরিত্যক্ত হলো প্রতিশোধমূলক রক্তের অধিকার। আর সুদ ইত্যাদি পাওনা-দেনাকেও আজ আমি পদদলিত করলাম।সর্বপ্রথম আমি নিজে রবীয়া ইবনে হারেছের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নিলাম। তবে কাবাগৃহের রক্ষণাবেক্ষণ ও হজযাত্রীদের পানি সরবরাহের দায়িত্বের কোনো পরিবর্তন হবে না। যারা এতোদিন ধরে এ দায়িত্ব পালন করতো, তারাই থাকবে তাদের স্ব স্ব দায়িত্বে।
আরো শোনো, লাঠি-সোটার আঘাতে নিহত, অথবা ভুলক্রমে, কিংবা ইচ্ছাকৃত হত্যাসদৃশ হত্যার রক্তপণ একশত উট। তার মধ্যে চল্লিশটিকে হতে হবে গর্ভবর্তী।অংশীদারকে লক্ষ্য করে ওছিয়ত করা যাবে না।নবজাতক হবে তার, যার শয্যায় সে জন্মগ্রহণ করেছে।ব্যভিচারের শাস্তি মৃত্যু পর্যন্ত প্রস্তরাঘাত। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী তার সম্পদ অন্যকে দিতে পারবে না।অমুসলিমদের বিপক্ষে সকল মুসলমান একটি বাহুর মতো। সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের বিপক্ষে কোনো বিশ্বাসী অথবা আশ্রিত সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীকে (জিম্মিকে) হত্যা করা যাবে না। বিপরীত ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অংশীদারিত্ব অচল। জাকাত-সংগ্রাহকরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে জাকাত সংগ্রহ করবে। জাকাতদাতাদেরকে জাকাত-দপ্তরে ডেকে আনা যাবে না। তারাও জাকাত-সংগ্রাহকদেরকে উত্যক্ত করতে পারবে না। কোনো রমণীর মা বা খালাকে বিবাহ করার পর আর তাকে বিবাহ করা যাবে না।
সাক্ষী উপস্থিত করা দাবিদারদের দায়িত্ব। সাক্ষী উপস্থিত না করতে পারলে শপথ করতে হবে। শপথ কার্যকর করা হবে দাবি অস্বীকারকারীর উপর। বিবাহ সিদ্ধঃ এমন কোনো পুরুষের সঙ্গে রমণীরা ভ্রমণে বের হতে পারবে না। ফজর ও আসরের নামাজ সমাপন করার পর আর কোনো নফল নামাজ আদায় করা যাবে না। দু’দিন রোজা রাখা নিষেধঃ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন। নিষেধ মাত্র একটি লুঙ্গি, অথবা মাত্র একটি জামা পরিধানের। কেননা এতে করে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হওয়ার রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। তেমনি নিষেধ একটি চাদর অথবা একটি কম্বল এমনভাবে পরিধান করাতে, যাতে দুই বাহু হয়ে যায় আবদ্ধ, যাতে প্রয়োজনের সময়েও হাত বের করা যায় না।
হে কুরায়েশ জনগোষ্ঠী! আল্লাহ্ দয়া করে মূর্খতার যুগের অহমিকা ও জাত্যাভিমান থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করেছেন। মনে রেখো, তোমরা সকলে এক আদমের সন্তান। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।সুতরাং তোমাদের গর্ব করার কিছু নেই। এরপর তিনি স. আবৃত্তি করলেন ‘হে মানবজাতি! আমি তো তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে.....’শেষ পর্যন্ত।
এবার বলো, হে মক্কাবাসী! তোমরা আমার কাছ থেকে কীরূপ আচরণ আশা করো? জনতা জবাব দিলো,আপনি সজ্জন, সাধু, আপনার পিতা-পিতামহও ছিলেন এরকমই। সুতরাং আপনার কাছ থেকে আমরা সেরকমই শিষ্টাচার আশা করি। তিনি স. বললেন, আজ তোমাদেরবিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ্ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনি তো দয়ার পারাবার।যাও, তোমরা সকলেই মুক্ত। সভা শেষ হলো। জনতা গাত্রোত্থান করলো। তাদেরকে দেখে মনে হলো, যেনো তারা এই মাত্র উঠে এসেছে কবর থেকে।
হজরত আবু হোরায়রা থেকে বোখারী বর্ণনা করেছেন,অজ্ঞতার যুগে বনী লাইছের জনৈক ব্যক্তি হত্যা করেছিলো বনী খাজাআর জনৈক ব্যক্তিকে। মক্কা বিজয়ের দিবসে সুযোগ পেয়ে বনী খাজাআ তাদের অপ-প্রতিশোধ চরিতার্থ করলো। তারা হত্যা করলো বনী লাইছের এক লোককে। রসুল স. একথা জানতে পেরে তাঁর ভাষণে বললেন, হে জনতা! দ্যাখো,আবরাহাবাহিনীকে আল্লাহ্ এ শহরে প্রবেশই করতে দেননি। অথচ তিনি তাঁর রসুল ও তাঁর অনুগামীগণকে মক্কাবাসীদের উপরে বিজয়ী করেছেন। ভালো করে শুনে রাখো, আমার পূর্বে জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। এরকম অধিকার আমার পরেও কেউ পাবে না। আমার পূর্বে এখানে রক্তপাত ঘটানো কারো জন্য বৈধ ছিলো না।এরপরেও বৈধ হবে না কারো জন্য। আর আমার জন্যও এ কাজ বৈধ ছিলো কেবল আজকের দিনের কিয়দংশের জন্য। এরপর থেকে চিরদিনের মতো এখানে রক্তপাত হারাম। এখানকার বৃক্ষ, লতা-গুল্ম কিছুই কর্তন করা যাবে না। কারো পরিত্যক্ত সম্পদ জোরপূর্বক অধিকার করলেও নয়। আরো শোনো, নরহত্যার বিনিময় রক্তপণ,অথবা হত্যা। আবু শাহ নামক জনৈক ইয়েমেনী ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রসুল। একথাটা আমাকে লিখে দিন। রসুল স. জনৈক সাহাবীকে নির্দেশ দিলেন বিধানটি লিখে দিতে। একজন কুরায়েশী দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশবাহক! বৃক্ষ-লতা-গুল্ম কর্তনের বিধান থেকে ইজখের ঘাসকে বাদ দিলে ভালো হয়। এটা আমাদের সাংসারিক প্রাত্যহিক কর্ম সমাধার জন্য অত্যাবশ্যক। তিনি স. বললেন, ঠিক আছে,ইজখের ঘাস থেকে কর্তনের নিষিদ্ধতা উঠিয়ে নেওয়া হলো।
এক বর্ণনায় এসেছে, এক লোক তখন দাঁড়িয়ে বললো,হে মহানবী! আমি এক রমণীকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলাম। তার কয়েকটি সন্তানও আছে। এখন তার প্রতি আমার কর্তব্য কী? তিনি স. বললেন, বিবাহ ব্যতিরেকে কোনো রমণীকে রক্ষিতা রাখা যাবে না।এরকম রমণীর সন্তান্তসন্ততি হবে অবৈধ। বংশপরিচয় ও উত্তরাধিকারিত্ব থেকে তারা হবে বঞ্চিত। আমার ধারণা,তোমরা আমার কথা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছো। আমি আল্লাহ্ সকাশে আমার ও তোমাদের জন্য মার্জনা যাচনা করি। রসুল স. ক্ষান্ত হলেন। এরপর তাঁর নির্দেশে জনৈক ঘোষক ঘোষণা করলেন, কোনো মুসলমানের গৃহে প্রতিমা থাকতে পারবে না। যদি থাকে তবে সেগুলোকে ভেঙেচুরে নিক্ষেপ করতে হবে দূরে।
জোহরের নামাজের সময় হলো। হজরত বেলাল নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে কাবাগৃহের ছাদে উঠে আজান দিলেন।কাবাপ্রাঙ্গণে উপবিষ্ট আবু সুফিয়ান, খালেদ ইবনে উসাইয়েদ ও হারেছ ইবনে হিশামের জাত্যাভিমান বিপর্যস্ত হলো। তাদের মনেহলো, কালো মানুষের কাবাগৃহের ছাদে ওঠার অধিকার থাকবে কেনো? খালেদ ইবনে উসাইয়েদ বলেই ফেললো, আল্লাহ্ আমার পিতার সম্মান রক্ষা করেছেন। এরকম অসহনীয় দৃশ্য দর্শনের পূর্বে তাঁকে তুলে নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। কেউ কেউ বললো, এখন বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ নেই।হজরত আবু সুফিয়ান বললেন, আমি কোনো মন্তব্যই করবো না। বললেন এখানকার পাথরগুলোই একথা রাষ্ট্র করে দিবে। হজরত জিবরাইল তাদের এমতো কথোপকথনের সংবাদ ঠিকই জানিয়ে দিলেন রসুল স.কে। রসুল স. তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,তোমরা যা কিছু বললে, তা আমাকে জানানো হয়েছে।তোমরা তো বললে এই কথাগুলো। ঠিক বলিনি? আবু সুফিয়ান তার সাথীদেরকে বললেন, কী, আমি কি বলিনি, এখানকার পাথরগুলোও আমাদের কথা প্রচার করে দিবে? খালেদ ও হারেছ বললো, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি সত্যি সত্যিই আল্লাহ্র রসুল।
হজরত আবু বকর সিদ্দীক তাঁর দৃষ্টিহীন পিতাকে হাত ধরে রসুল স. এর কাছে হাজির করলেন। রসুল স. বললেন, আবু বকর। তিনি তো বয়োবৃদ্ধ। তাঁকে এভাবে কষ্ট দিলে কেনো? আমি তো নিজেই তাঁর কাছে যেতে পারতাম। রসুল স. সস্নেহে তাঁর বুকে পিঠে হাত বুলালেন।তিনিও অনায়াসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তখন তাঁর মস্তক ও শ্মশ্রুর কেশরাজি হয়ে গিয়েছিলো ছাগামফূলের মতো শাদা। রসুল স. সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন,কালো রঙ ছাড়া অন্য যে কোনো রঙ দ্বারা রঙ পরিবর্তন করে দিয়ো।
রসুল স. উপবেশন করলেন একটি উঁচু স্থানে।অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানে বসলেন হজরত ওমর। দলে দলে লোক এসে রসুল স. এবং হজরত ওমরের হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। পুরুষদের পালা শেষ হলো। এগিয়ে এলো মেয়েরা। তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হলো তাদের হস্তস্পর্শ না করেই,কেবল মুখে মুখে। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হোরায়রা বর্ণনা করেছেন, রসুল স. সাফা পর্বতে আরোহণ করলেন। কাবাগৃহের দিকে চেয়ে ভাবের আবেগে আপ্লুত হলেন। হাত তুলে শুরু করলেন অন্তরঙ্গ প্রার্থনা। পর্বতের সানুদেশে দণ্ডায়মান আনসার সাহাবীগণ সেই অপূর্ব মায়াভরা দৃশ্য দেখে এই ভেবে শংকিত হলেন যে, রসুল স. এর জন্মভূমির আকর্ষণ উত্তাল হয়ে উঠেছে। এটাই তো স্বাভাবিক। তিনি মনে হয় আমাদের সঙ্গে আর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবেন না। প্রার্থনা শেষ হলো। রসুল স. নিচে নেমে এসে মিলিত হলেন আনসারগণের সঙ্গে। সম্বোধন করলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তাঁরা উচ্চকণ্ঠে জবাব দিলেন, হে মহানবী! এই যে আমরা। তিনি স. বললেন, তোমরা তো এসকল কথা ভেবে শংকিত হয়েছিলে, না? তাঁরা স্বীকার করলেন, হে মহান রসুল! আপনি ঠিকই বলেছেন। তিনি স. বললেন,নিশ্চয় তোমাদের আশংকা ভিত্তিহীন। আমি তো আল্লাহ্র সনে�াষ কামনায় তোমাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি।তোমাদের ও আমার জীবন মরণ সব একাকার।আনসারগণ কেঁদে ফেললেন।
বললেন, হে আল্লাহ্র প্রিয়তম জন! আপনার প্রতি আমাদের উদগ্র ভালোবাসাই আমাদেরকে শংকাগ্রস্ত ও বিমর্ষ করে তুলেছিলো। আমরা আমাদের অপভাবনার জন্য মার্জনাপ্রার্থী। তিনি স. তাঁদের অজুহাত গ্রহণ করলেন।
মক্কাবিজয়ের দিবসে রসুল স. তিন ব্যক্তির নিকট থেকে আর্থিক ঋণ গ্রহণ করে তা বণ্টন করে দিয়েছিলেন অস্বŽছল সাহাবীগণের মধ্যে। সাফওয়ান ইবনে উয়াইনার নিকট থেকে নিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার, আবদুল্লাহ্ ইবনে রবীয়ার নিকট থেকে চল্লিশ হাজার এবং হুয়াইতাব ইবনে আবদুল উজ্জার নিকট থেকে চল্লিশ হাজার। এ সকল ঋণ তিনি পরিশোধ করেছিলেন হুনায়েন যুদ্ধের পর। রসুল স. সেদিন বলেছিলেন, আজকের দিনের পর মক্কার উপরে আর কোনো অভিযান পরিচালিত হবে না।হিজরতের প্রয়োজনও আজ থেকে শেষ হয়ে গেলো।
আবু ইয়ালা ও আবু নাঈমের বর্ণনায় এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, মক্কাবিজয়ের পর শয়তান উচ্চস্বরে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জবাবে বলে,আর কখনো আশা কোরো না যে, উম্মতে মোহাম্মদী শিরিকের দিকে ফিরে আসবে। মাকহুল সূত্রে ইবনে আবী শায়বা বর্ণনা করেছেন, রসুল স. যখন বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন ইবলিস তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলো বিরাট বিরাট অগ্নিকুণ্ড। হজরত জিবরাইল তৎক্ষণাৎ রসুল স.কে একটি দোয়া শিখিয়ে দিলেন। দোয়াটি এরকম ‘আঊ’জু বিকালিমাতিললাহিত্ তামমাতিল লাতী লা ইউজ্বাউইবু হুন্না বাররুউঁ ওয়ালা ফাজ্বির মিন শররি মা নাযালা মিনাস সাজা ওয়ামা ইয়া’রুজ্বু ফীহা ওয়ামিন শাররি মা বাছ্ছা ফীল আরদ্ব ওয়ামা ইয়াখরুজ্বু মিনহা ওয়া মিন শাররিল লাইলি ওয়ান নাহার ওয়া মিন শাররি কুললি ত্বরিক ইয়াত্বরুকু বি খইর ইয়া রহমান’। ইবনে আবী বাযযার সূত্রে বায়হাকী বর্ণনা করেছেন, মক্কাবিজয়ের দিন দেখা গেলো, বিদখুটে কদাকার এক হাবশী বৃদ্ধা তার নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে এবং চীৎকার করে কাঁদছে। রসুল স.কে যখন তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো তখন তিনি স. বললেন, সে ছিলো পৌত্তলিক কুরায়েশদের আরাধ্য দেবী। সে বলছে,তোমাদের শহরে আজ থেকে আমার উপাসনা হয়ে গেলো চিররুদ্ধ।
সেদিন প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হলো ‘আল্লাহ্ তোমাদেরকে আদেশ করছেন, তোমাদের নিকটে রক্ষিত গচ্ছিত সম্পদ তার প্রাপককে ফিরিয়ে দাও’। রসুল স. তখন ওসমান ইবনে আবী তালহাকে ডেকে এনে তার হাতেই পুনঃ অর্পণ করলেন কাবা গৃহের চাবি। বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত এ চাবি রক্ষিত হতে থাকবে তোমার বংশধরের মধ্যেই। জালেম ব্যতীত অন্য কেউ তোমাদের কাছ থেকে এ চাবি ছিনিয়ে নিতে পারবে না। চাবিবহনের এ মহান দায়িত্বের জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকেই মনোনীত করেছেন। এই উপলক্ষে যা কিছু তোমাদের হস্তগত হবে,তা তোমাদের জন্য বৈধ। এরকমও বর্ণিত হয়েছে যে,হজরত জিবরাইল তখন বলেছিলেন, যতোদিন পর্যন্ত এ গৃহ স্থায়ী থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত এ গৃহের তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পালন করবে ওসমান ও তাঁর বংশধরেরা। উল্লেখ্য,হজরত ওসমান পরলোক গমনের প্রাক্কালে কাবাগৃহের চাবি হস্তান্তর করেন তাঁর ভাই হজরত শায়বার হাতে। তাঁর বংশধরেরাই এ পর্যন্ত চাবি বহন করে আসছেন। বহন করবেন মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত।
বোখারীর বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. মক্কায় অবস্থান করেছিলেন ঊনিশ দিন। ওই সময় তিনি নামাজ আদায় করতেন কসর হিসেবে। আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে,তিনি স. তখন মক্কায় অবস্থান করেছিলেন সতেরো রাত এবং বোখারীর অপর বর্ণনায় এবং তিরমিজির বিবরণে বলা হয়েছে, তিনি স. তখন মক্কায় যাপন করেছিলেন আঠারো রাত। এমতো বর্ণনাবৈষম্য নিরসনার্থে বলা যায়,আগমন ও প্রস্থানের দিন বিয়োগ করলে সতেরো রাতই হয়, আর যোগ করলে হয় ঊনিশ দিন। আর প্রহর হিসেবে গণনা করলে হয় আঠারো।
মক্কাবিজয়ের পর সমগ্র আরব স্তম্ভিত হয়ে গেলো।লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, যে আল্লাহ্ আবরাহার হস্তিযুথকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, সেই আল্লাহ্ই মোহাম্মদকে দান করলেন মহাবিজয়। এখন তোমরাই বলো, তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর আছে কি? সত্যি সত্যিই তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত রসুল। এরকম কথাবার্তা ও সিদ্ধান্ত চলতে লাগলো বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্রগুলোর মধ্যে। শেষে সকলে একে একে দ্বিধাহীন চিত্তে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে লাগলো ইসলামের চির-সুশীতল ছায়ায়। এই সুরার দ্বিতীয় আয়াতে সে কথাটিই বলে দেওয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে ‘এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহ্র দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে’। ইকরামা ও মুকাতিল বলেছেন,এখানে ‘মানুষ’ অর্থ ইয়েমেনবাসী। রসুল স. একবার বলেছিলেন, ইয়েমেনবাসীরা তোমাদের কাছে এসেছে।এরা অতীব বিনম্র এবং ইমান গ্রহণের ক্ষেত্রে কোমল হৃদয়বিশিষ্ট। জ্ঞানের উৎপত্তি ইয়েমেন দেশে। শোনো,উটের মালিকের কাছ থেকে প্রকাশ পায় উন্নাসিকতা ও আত্মম্ভরিতা এবং ছাগলের মালিকের নিকট থেকে প্রকাশ পায় সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচার।